আজকের অগ্রবাণী ডেস্ক: | ০৫ জুলাই ২০১৭ | ৯:০৪ অপরাহ্ণ
অপরাধ ও অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে রাজধানীর অনেক আবাসিক হোটেল। হোটেলকক্ষে খুন, অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রতারণার মাধ্যমে নগ্ন ছবি ধারণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসরসহ নানা রকম অপরাধ হরহামেশাই সংঘটিত হচ্ছে। এ ছাড়া সারাদেশের বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত অনেক অপরাধী নিরাপদে অবস্থান করছে এসব হোটেলে। মহানগরীর নামিদামি কিছুসংখ্যক হোটেল ছাড়া অধিকাংশ হোটেলে রাখা হচ্ছে না অতিথিদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য। সঠিক তথ্য না থাকায় সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে আবাসিক হোটেল রয়েছে প্রায় ৯০০। এর মধ্যে ৭২২টির হোটেল ব্যবসার অনুমোদন নেই। লাইসেন্স ছাড়াই চলছে তাদের রমরমা হোটেল ব্যবসা। ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। গত ১০ বছরে ঢাকার আবাসিক হোটেল থেকে তিন শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, আবাসিক হোটেলে অপরাধ দমনে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীর আবাসিক হোটেল মালিকদের প্রতি বোর্ডার (অভ্যাগত) এন্ট্রি ফরমে বোর্ডারদের নাম-ঠিকানা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও মোবাইল ফোন নম্বর লেখার ও তা সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়। একই নির্দেশনায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও বোর্ডারদের ছবি তুলে রাখার কথাও বলা হয়। অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য বোর্ডারের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তা সঠিক কি না, তাও তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করে নেয়ার ব্যাপারে ডিএমপির নির্দেশনা রয়েছে।
সর্বশেষ পূরণ করা তথ্য ফরমের ফটোকপি প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানোর নির্দেশ থাকলেও হোটেল মালিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর কোনোটাই অনুসরণ করছেন না। ফলে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও পুলিশ সদস্যদের পক্ষে অপরাধী শনাক্ত করা কিংবা দুর্ঘটনার শিকার কারো পরিচিতজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে সাধারণ বোর্ডারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও থেকে যায় ঝুঁকির মুখে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান জানান, আমাদের দেশের আবাসিক হোটেলগুলোকে অপরাধীরা এক ধরনের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আবাসিক হোটেলগুলোর ওপর সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি বৃদ্ধি করা উচিত। অতিথিদের তথ্য সংরক্ষণ আরো আধুনিক হওয়া উচিত। অনেক সময় ভুয়া এনআইডি কার্ড দিয়ে অপরাধীরা হোটেলে অবস্থান করে থাকে। এ ক্ষেত্রে এনআইডি কার্ড যাচাই করার সুয়োগ যদি হোটেল কর্র্তৃপক্ষের থাকে, তাহলে আপরাধ কমবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
২১ মে রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকার আল শাহিন আবাসিক হোটেল থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাত নারীর লাশ ও তার ২৫ দিনের নবজাতক কন্যাশিশুকে। পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, আগের দিন রাত ৩টার দিকে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে নবজাতকসহ হোটেল আল শাহিনে উঠেন তারা। খুব ক্লান্ত ও বাচ্চা অসুস্থতার কথা বলে কোনো তথ্য ফরম পূরণ না করেই হোটেলের কক্ষে উঠে যান তারা। পরদিন সকালে হোটেল ম্যানেজার তাদের তথ্য আনার জন্য গেলে কক্ষটি তালাবদ্ধ অবস্থায় শিশুর কান্নার শব্দ পান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তালা ভেঙে গলায় ওড়না গিঁট দেয়া অবস্থায় খাটের ওপর থেকে ওই নারীর লাশ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, ওই নারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
পরে পুলিশের তত্ত্বাবধানে অসুস্থ কন্যাশিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হয় দীর্ঘদিন। আর নিহত নারীর পরিচয়ের খোঁজে তার আঙ্গুলের ছাপ পাঠানো হয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু সেখানেও তার কোনো পরিচয় খুঁজে পায়নি পুলিশ। অন্যদিকে স্বামী পরিচয়ে হোটেলে ওঠা সেই ঘাতকের কোনো খোঁজ পায়নি পুলিশ।
এর আগে ১৫ মে ফকিরাপুল কাঁচাবাজারে অবস্থিত আসমা আবাসিক হোটেল থেকে জামাল হোসেন (৫০) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
১৯ এপ্রিল উত্তরায় নীলা আবাসিক হোটেল থেকে পুষ্পরানী নামে এক নারীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হোটেলে ওঠার আগে ওই নারী নিজের নাম পুষ্পা (৩০) ও সঙ্গে এক পুরুষের নাম দুর্জয় (৪০) ও এক শিশুকে সন্তান পরিচয় দিয়ে একটি রুম ভাড়া নেন। কিন্তু পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই পরিচয় ছিল সম্পূর্ণই ভুয়া। তাদের সঙ্গে থাকা ওই শিশুটি তার নাতনি। নাম মনীষা। নাতনি মনীষাকে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রিতে বাধা দিতে গেলে ওই কথিত স্বামী লিটনের হাতে নির্মমভাবে খুন হন তিনি। পরে ২৪ এপ্রিল ঘাতক লিটনকে কমলাপুরের একটি আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ফকিরাপুলের একটি আবাসিক হোটেল মালিক জানান, বোর্ডারদের কাছে অনেক সময় ছবি আইডি কার্ড থাকে না। তা ছাড়া এগুলো অনেকে দিতেও চায় না। বেশি কড়াকড়ি করলে তো আর ব্যবসা চলবে না। এই এলাকার বেশির ভাগ আবাসিক হোটেলেই সিসিটিভি ক্যামেরা ও বোর্ডারদের ছবি তুলে রাখার ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রশাসনকে নিয়মিত চাঁদা দিয়েই হোটেল ব্যবসা চালানোর কথা স্বীকার করেন তিনি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন জানান, আবাসিক হোটেলগুলো প্রতিদিনেরই তথ্য নিকটস্থ থানায় দিয়ে থাকে। থানার সংশ্লিষ্টরা এই বিষয়ে তদারকি করে থাকেন। এর বাইরে যদি কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা থাকে- আমরা এসবের বিরুদ্ধে নিয়ে থাকি। আমরা হোটেল মালিকদের নিয়ে মিটিং করছি। নিয়মিত তাদের চিঠি দেয়া হচ্ছে। এতে সাড়া দিয়ে অনেক মালিকই সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোর্ডারদের তথ্যও পাচ্ছে পুলিশ।