অনলাইন ডেস্ক | ১৪ মার্চ ২০১৭ | ৫:০০ অপরাহ্ণ
প্রিন্সটনের আকাশে কড়া রোদ। চোখ ঝলসানো আলো। তবে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। ঠান্ডায় রক্ত জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। ধূমায়িত নিশ্বাসে আমার চোখের গ্লাস কিছুটা ঘোলা হয়ে আসে। ৫ মার্চ রাস্তার ধারে হাঁটছি চুপচাপ। আগন্তুকের মতো এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি। এই রাস্তার নাম ‘মার্সার স্ট্রিট’। এই স্ট্রিটের ১১২ নম্বর বাড়ি খুঁজছি। আমার ভরসা জিপিএস।
রাস্তার দুধারে বাড়িগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে উপায় নেই। এক পাশে বিজোড় নম্বরের বাড়ি, অন্য পাশে জোড় নম্বর। ঘুরতে ঘুরতে একসময় কাঙ্ক্ষিত বাড়ির আঙিনার কাছে এলাম! ছোট্ট একটা ফটক সরিয়ে বাড়ির দরজায় টোকা দিচ্ছি মৃদু। জোরে কড়া নাড়লে যদি কেউ তেড়ে আসে—মনে সেই ভয়। কয়েক মিনিটের অপেক্ষার পরও কেউ দরজা খোলেনি। উঁকিঝুঁকি দিয়ে আঙিনাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি জানি, বাড়ির মালিক এখানে নেই। তিনি গত হয়েছেন ষাট বছর আগে। কিন্তু তাতে কী! তাঁর পদচারণ রয়ে গেছে। মানুষ তাই এখানে আসে।
মার্সার স্ট্রিটের ১১২ নম্বর বাড়ির ঠিকানা পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে জানা। কারণ, এই বাড়িটায় থাকতেন আলবার্ট আইনস্টাইন। যিনি গোটা পৃথিবীর কাছেই জিনিয়াস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই আইনস্টাইন জার্মানি ছাড়েন। মাতৃভূমি জার্মানি তাঁর জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে। তাঁর অপরাধ—ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও ব্যক্তি আইনস্টাইনের ধর্ম ছিল ‘ভাবনা’। জগতের অদৃশ্য রহস্যের টুকরোগুলো ছকে ফেলা। তাঁর প্রেম ছিল গাণিতিক সূত্রের সঙ্গে। অথচ তাঁকেও মাতৃভূমি ছাড়তে হলো পারিবারিক ধর্মের জন্য! ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ মেধাবী কী করে এত ঠুনকো কারণে রাজনীতির শত্রু হতে পারে—আইনস্টাইন তার অদ্বিতীয় উদাহরণ!
যাঁর জন্য পুরো পৃথিবী ঘর সাজিয়ে রেখেছে, তাঁর জন্য অবশ্য দেশ খুবই ক্ষুদ্র! আইনস্টাইন আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পৌঁছালেন আমেরিকায়। তাঁর জীবন শুরু হয় প্রিন্সটনে। অধ্যাপনা শুরু করেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অ্যাডভান্সড স্টাডি ইনস্টিটিউটে। তত দিনে তিনি অবশ্য নোবেল বিজয়ী। প্রিন্সটনের ‘মার্সার স্ট্রিটে’ তাঁকে বাড়ি দেওয়া হলো। আমৃত্যু সে বাড়িতেই থেকেছেন। সময়টা ১৯৩৫ থেকে ১৯৫৫ সাল।
সেই বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছি। বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখছি। ছবি তুলছি খেয়ালখুশিমতো। এমন সময় গেটের কাছে এক যুগল এসে ইতস্তত তাকাচ্ছে। তাদের চোখ দেখেই বুঝেছি, কী খোঁজে ওরা। বললাম, আর ইউ গাইজ লুকিং ফর আইনস্টাইনস হাউস?—ওহ্, ইয়েস! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে যেন এক স্বস্তির উচ্চারণ। ইউ আর অ্যাট দ্য রাইট প্লেস—বলতেই সমস্বরে দুজন ধন্যবাদ দিতে লাগল। ম্যানহাটন থেকে এসেছে ওরা। ওদের ছবি তুলে দিলাম। ওরা দিল আমার।
এই যে নক্ষত্রের আলোককণা, কী তুমুল শাণিত করছে প্রিন্সটনের ঘাস, ফুল আর জলধারা—এই কণাদের মুঠিবদ্ধ করেছিলেন আইনস্টাইন। আলোকের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল খুব। রবীন্দ্রনাথ আলোকের ভুবনে নেচে উঠতেন। শব্দের ছবিতে এঁকেছিলেন আলো। আর আইনস্টাইন সেই আলোর ভেতরে ঢুকে গিয়ে এর সত্য-সুন্দর রহস্য বের করে এনেছেন। সৌরজগতের মতো যে পরমাণু, সেটার গহিন থেকে কণার আঘাতে কণা বের করে এনেছেন। অনেকটা পানি দিয়ে কানের পানি বের করার মতো। তিনি এর নাম দিয়েছেন ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট। যে জিপিএস দিয়ে তাঁর বাড়ি খুঁজছি, সেই জিপিএস হলো তাঁরই কর্মের ফসল। তিনি বলেছিলেন, এই মহাবিশ্বের সর্বত্র, সময় এক থাকে না। স্থান বদলালে সময় বদলে যায়। বিজ্ঞান এটাকে বলে রিলেটিভিটি থিউরি।
সাদা বাড়িটার আঙিনায় যেন তাঁর শব্দ শোনা যায়। মনে হয় তিনি যেন কথা বলছেন সৃষ্টির সঙ্গে। তাঁর প্রিয় পাইপে ঠোঁট লাগিয়ে কী গভীর ভাবছেন! হুট করে খেপে গিয়ে বলছেন, ‘গড ডাজ নট প্লে উইথ ডাইস’। তাঁর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠছেন নিলস বোর! বাড়ির দরজা-জানালাগুলো ঠান্ডায় কী কঠিনতর হয়ে আছে! তবু সেখানে স্পর্শ করলে কিসের যেন একটা ছোঁয়া অনুভব করা যায়। আলো নেচে ওঠে কী তুমুল ঝংকারে। আলোরা এখানে হিমায়িত হয় কিন্তু ঔজ্জ্বল্য হারায় না। আমি জানি, এই হিম আলোকের দুয়ারে কখনো অন্ধকার আসে না।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে তাঁর একটি ব্রোঞ্জ মূর্তির দেখা মেলে। যদিও পুরো ক্যাম্পাসেই মিশে আছেন তিনি। আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর তাঁর দেহভস্ম এই ক্যাম্পাসেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট সমাধি নেই। যাঁর কর্ম এত বিস্তৃত, তাঁকে খুঁজতে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আইনস্টাইন সেটা উপলব্ধি করেছিলেন। নক্ষত্রের আলোকের মতোই বিকিরিত হয় তাঁর সৃষ্টির দ্যুতি। ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে। আমি সেই আলোকধারার মাঝে তাকিয়ে দেখি আইনস্টাইনের আকাশ।
লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব প্যানসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
আইনস্টাইনের পাইপ
আমেরিকান জুইশ হিস্ট্রি জাদুঘর দেখা হয়েছিল গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। জাদুঘরের প্রদর্শনী দেখতে দেখতেই একসময় চোখে পড়ে আইনস্টাইনের পাইপটিতে। মহান এই বিজ্ঞানী মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাঁর ভাস্কর বন্ধু গিনা প্লাংগুইয়ানকে পাইপটি স্মারক উপহার দেন। গিনা সেই পাইপটি পরবর্তীকালে জাদুঘরে দেন। আইনস্টাইনের পাইপটি, ফিলাডেলফিয়ার মিউজিয়াম অব অ্যামেরিকান জুইশ হিস্ট্রিতে সংরক্ষিত আছে।