অনলাইন ডেস্ক | ০৪ নভেম্বর ২০১৭ | ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ
উপমহাদেশে বহু অভ্যুত্থান ঘটেছে। সহজ ভাষায় সেনা অভ্যুত্থান মানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সেনাপতির মধ্যে যুদ্ধ। প্রতিবার এই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি জয়ী হয়েছেন। কিন্তু একমাত্র দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৯৬ সালের ২০ মে সংঘটিত অভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধান সেনাপতি জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের নিকট পরাজিত হন।
আমি সবসময় বলি, এজন্য উপমহাদেশ, এমনকি বিশ্বে ঘটা সামরিক অভ্যুত্থানগুলোর ইতিহাসে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে ঘটা ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের আলাদা মরতবা রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে জেনারেল নাসিম জেনারেল পিনোশের মতো প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে গোলা নিক্ষেপ করে প্রেসিডেন্টকে খুন করতে পারতেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস আজ ৯২ বছর বয়সে মারা গেছেন। শুনেছি ১৯৭১ সালে সাবেক এই মুসলিম লীগার পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। যদিও ১৯৭৪ সালে তাঁকে বরিশাল বার কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দেখা যায়। তবে ১৯৯৬ এর ঘটনায় গণতন্ত্রের স্বার্থে আবদুর রহমান বিশ্বাসের সাহসিকতা আর প্রধান সেনাপতির বিরুদ্ধে সফলতা অতীত ইতিহাসের সাথে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে কিনা, তা ভবিষ্যৎ বলবে।
১৯৯৬ সালে আমি নেহায়েত ছোট। তবে আবদুর রহমান বিশ্বাসের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার মনে পড়ছে ২১ বছর আগে ২০ মের বিকালের কথা। আব্বার সাথে বসে টিভিতে প্রেসিডেন্ট বিশ্বাসের ভাষণ শুনছিলাম। মনে পড়ে তিনি বলছিলেন, “… সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রমকে এখন থেকে অব্যহতি প্রদান করছি।” আমার মনে পড়ে ছাই রংয়ের সুট পরিহিত প্রেসিডেন্টের হাত জোড়ার মৃদু কম্পন আমি ব্যগ্র হয়ে দেখছিলাম চোখ বড় বড় করে!
সেই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল আবদুল মতিন। অভ্যুত্থান বিষয়ে লেখা তাঁর বই পাঠে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করে প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস চিন্তিত ছিলেন পাছে তাঁকে মানুষ রাজাকার বলে গালাগাল করে। যার জন্য তিনি পরবর্তী প্রধান সেনাপতি হিসেবে একজন মুক্তিযোদ্ধা জেনারেলকে খুঁজছিলেন।
প্রথমে প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস তখনকার দিনে ময়মনসিংহে থাকা ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইন উদ্দীনকে নতুন চীফ করতে সাব্যস্ত করেন। কিন্তু দেখা গেলো, জেনারেল আইন উদ্দীন নিজেও জেনারেল নাসিমের সমর্থক ও অনুগত। এমনকি জেনারেল নাসিমের অনুকূলে প্রেসিডেন্টকে ঘেরাও করতে তিনি ততোক্ষণে তাঁর অধীনস্থ একটি ব্রিগেডকে ঢাকার পথে পাঠিয়েও দিয়েছেন!
এরপর প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস তাঁর সামনে থাকা দুই মুক্তিযোদ্ধা, ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মতিন এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তৎকালীন প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়ার মধ্যে একজনকে প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণে আহবান জানান।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এরা দুজনেই প্রেসিডেন্টের আহবান খারিজ করেন। তখন প্রেসিডেন্ট অবসরে যাবার দ্বারপ্রান্তে থাকা সেনাবাহিনীর তৎকালীন সিজিএস মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে পরবর্তী প্রধান সেনাপতি হিসেবে সাব্যস্ত করেন। জেনারেল মাহবুব ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার। এই নিয়োগ প্রেসিডেন্ট বিশ্বাসকে ঠিকই সমালোচিত করেছিলো।
তখনকার সময়ে নিয়োজিত জিওসিগণের মধ্যে প্রধান সেনাপতি করার মতো কয়জন ছিলেন তা তর্ক সাপেক্ষ। আমি কিছুদিন আগেও ভাবতাম কুমিল্লার জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন, সাভারের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান এবং চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমানের মধ্য থেকে কেন কাউকে চীফ হিসেবে নেয়া হয়নি? এদের মধ্যে জেনারেল আজিজ ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্ব খেতাব ‘বীর উত্তম’ প্রাপ্ত।
পরে অবশ্য জানতে পারি, এনারা সবাই ছিলেন অনেক জুনিয়র, এমনকি কতিপয়ের মধ্যে জেনারেল নাসিমের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য থেকে থাকতে পারে, এমন ভয়েই প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস ঢাকার বাইরের কোন জেনারেলের উপর আস্থা পোষণ করেননি…।
ছবি- ১৯৯৬ সালের মে মাসের সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার পর নবনিযুক্ত প্রধান সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান প্রথমবারের মতো বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে গিয়ে মোসাফা করছেন।