ডক্টর শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ
পবিত্র আশুরা অর্থাৎ ১০ মহররমের দিনটি বিশ্বাসীদের কাছে নানা কারণে তাত্পর্যপূর্ণ। এ দিনে দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয় আবার এ দিনে বিবি হাওয়া (আ.)সহ তাকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
এ পবিত্র দিনেই তারা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন। আশুরার সঙ্গে অসংখ্য নবীর স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। ১৩৭৭ বছর আগে হিজরি ৬১ সনের এই দিনে কারবালার প্রান্তরে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদাতবরণ করেন।
ইসলামী বিধানকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন তিনি। অন্যায়ের কাছে মাথানত করার বদলে শাহাদাতবরণকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন এ মহাপুরুষ। ইমাম হোসাইন (রা.) তথা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রক্তের উত্তরাধিকার এবং তাদের অনুসারীদের অসামান্য আত্মত্যাগের কথা এ দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বিশ্বাসী মানুষ। শোকাবহ এ দিনটি তাদের কাছে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার দিন। কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার শিক্ষা দেয়। সত্যের সঙ্গে অসত্যের লড়াই এক চিরন্তন সত্য। মক্কার বুকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলার যে জীবন বিধান প্রবর্তন করেন তাতে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণের প্রতিভূরা। একপর্যায়ে তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামী পতাকার নিচে আশ্রয় নেয়।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর শুরু হয় গোত্রতন্ত্র ও কায়েমি স্বার্থের ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয় নবী দৌহিত্র হজরত হাসান (রা.)-কে। কারবালায় ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন অনুসারীসহ শাহাদাতবরণ করেন ইমাম হোসাইন। কারবালার ঘটনা শিক্ষা দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যে লড়াই তা অপরাজেয়। ইয়াজিদ বাহিনী হোসাইন (রা.), তার পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীদের জীবন কেড়ে নিতে পারলেও ইতিহাস তাদের আদর্শের অমরতাকেই স্মরণ করে। অন্যায় যুদ্ধে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া জয়ী হলেও সে জয় ছিল পরাজয়ের চেয়েও লজ্জাকর। পক্ষান্তরে হজরত হোসাইন (রা.)-কে ইতিহাসে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতীক হিসেবে যুগে যুগে স্মরণ করা হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে।
ইসলামের পরিভাষায় আশুরা বলতে মহররম মাসের ১০ তারিখকেই বোঝায়। হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। প্রথম মাস হিসেবে মহররম যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আশুরা। মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে বহু উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া ও ধ্বংস-সৃষ্টির স্মৃতি ধারণ করে আছে এই আশুরা। এই দিনে আল্লাহ তাআলা আদি পিতা আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে সদলবলে সাগরে ডুবিয়ে মেরেছেন। ইতিহাসে এই দিনে সংঘটিত আরো অনেক তাত্পর্যময় ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ৬১ হিজরিতে এই দিনেই ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে মানব ইতিহাসের নির্মমতম, সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাটি ঘটে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-র পুত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) দামেস্কের অধিপতি ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন।
কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত সেদিনের এই নিষ্ঠুরতা আজও এই দিনটিতে সারা বিশ্বের মুসলমানের হৃদয় ভারাক্রান্ত করে। তাই মুসলমানরা এই দিনটিতে নিজেদের ইমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়। কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রা.) নিজের প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার যে শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন, তা সমুন্নত রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সব রকম লোভ, মোহ ত্যাগ করে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, আদর্শ ও চেতনার বিস্তার ঘটানো। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়—‘ফিরে এল আজ সেই মহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না। ’
প্রাক-ইসলামী যুগেও আশুরার ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। সময়ের ব্যবধানে চেতনার জায়গায় আশুরা আজ ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় পেয়েছে। কোথাও দিনটিকে স্মরণ করা হয় শোকের স্মারক হিসেবে, কোথাও আনন্দের উপাদান, আবার কোথাও বা প্রতিবাদের উপলক্ষ হিসেবে। তাই দিবসটি পালন বা উদ্যাপনের প্রকাশও হয় ভিন্ন ভিন্ন। হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসারী দাবিদার ইহুদিরা এ দিনে উপবাস করে। শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিল করে। স্বীকৃত বিভিন্ন হাদিসে আশুরা উপলক্ষে মুসলমানদের দুই দিন নফল রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি মুসলমানদের আশুরা ও কারবালার মূল চেতনা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। সারা বিশ্বে মুসলমানরা আজ নানাভাবে নিগৃহীত। নানা ধরনের ভ্রান্তি ও চক্রান্তের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বাড়ছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে সহিংসতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় আশুরার এই দিনে মুসলমানদের নতুন করে শপথ নিতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সত্য ও সুন্দরের আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের জয় হোক।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম এবং প্রধান সম্পাদক দৈনিক আজকের অগ্রবাণী।
e-mail: advahmed@outlook.com