| ১৫ জানুয়ারি ২০২১ | ১০:৩২ অপরাহ্ণ
মজার এক খেলা হুমগুটি। গুটি লুকানোর এই খেলায় নেই কোনো বিচারক। কোনো খরচও হয় না এতে। খেলোয়াড়ের সংখ্যারও কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যত খুশি খেলোয়াড় একসঙ্গে অংশ নিতে পারে একেকটি দলে। এক মণ ওজনের পিতলের গুটি যারাই লুকাতে বা গুম করতে পারে তারাই হয় জয়ী।
পৌষের শেষ দিনে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার লক্ষীপুর গ্রামের তালুক-পরগনা সীমানার বড়ই আটা বন্দে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে হুমগুটি খেলায়। এবারে খেলায় ত্রিশালের কাটাখালি এলাকার দল ‘পুব্বা’ জয়ী হয়েছে।
পৌষ মাসের শেষ দিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। এ দিনে একই সময়ে একই স্থানে যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই হুমগুটি খেলা। ফুলবাড়িয়ার লক্ষীপুর গ্রামের বড়ই আটা বন্দে হুমগুটি খেলায় অংশ নিতে বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে থাকেন মানুষজন। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যায় পরিণত হয় জনসমুদ্রে। এলাকাভিত্তিক একেকটি দলে শতশত খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণে চলে গুটি দখলের শক্তির লড়াই। এ খেলাকে কেন্দ্র করে লক্ষীপুর, দেওখোলাসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে চলে উৎসবের আমেজ।
এদিকে হুমগুটি খেলাকে ঘিরে বসা গ্রামীণ মেলায় শিশুদের খেলনা ও খাবারের দোকানেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। খেলা দেখতে সপরিবারে এসেছিলেন অনেকে। খেলা দেখে শিশুদের বায়না পূরণ করে বাড়ি ফেরেন অন্যরকম এক প্রশান্তি নিয়ে। শিশুরা ছিল সবচে বেশি খুশি।
জানা যায়, মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্ত মহারাজের সাথে ত্রিশালের বৈলরের হেম চন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে। আর পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূখণ্ডে দুই নীতির প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসার জন্য লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে আয়োজন করা হয় এই হুমগুটি খেলা। শর্ত ছিল, গুটি যে দিকে যাবে তা হবে তালুক। আর পরাজিত অংশের নাম হবে পরগনা। সে সময় গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হন।
তালুক ও পরগনার সীমান্তে জিরো পয়েন্টে ব্রিটিশ আমলে জমিদারি এই খেলার গোড়াপত্তন। আমন ধান কাটা শেষ, বোরো ধান আবাদের আগে প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য জমিদারদের এই পাতানো খেলা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব ও পশ্চিম ভাগবাটোয়ারা করে খেলা শুরু হলেও পরে আর কোন দিক থাকে না খেলোয়াড়দের। এক মন ওজনের পিতলের গুটি মাঠে আসার পরই গুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজারো মানুষ। টানাহেচড়া ধাক্কাধাক্কি সবই হয় এ খেলায়। হয় না কেবল কোনো সংঘর্ষ।
গোলাকার বস্তুটি নিয়ে হাজারো মানুষের কাড়াকাড়িতে সকলের মুখে উচ্চারিত হয় ‘গুটি ধররে হেইও…..’।
উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষিপুর ও ১০ মাইলের মাঝামাঝি বড়ই আটা বন্ধ নামক ফসলি জমির খালি বড় মাঠ হলো খেলাটির কেন্দ্রস্থল।
হুমগুটি খেলার সমন্বয়ক এম এ কুদ্দুছ জানান, আড়াইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। হুমগুটি খেলাকে ঘিরে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। খেলার ২ থেকে ৩ দিন আগে থেকেই আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসেন এই এলাকায়। শুধু লক্ষীপুর গ্রামেই ৪০টি গরু জবাই হয়েছে এই উৎসবকে ঘিরে।
স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ সদস্য তাজুল ইসলাম বাবলু জানান, গুটি খেলায় এবার করোনার প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসন গুটি খেলার আয়োজকদের ডেকে এবারের গুটি খেলা নিষেধ করেছিলেন। খেলার মাঠে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ। তারপরও খেলা হয়েছে। গুটি খেলা ফুলবাড়িয়া উপজেলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খেলা। আড়াইশ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী গুটি খেলা এখনও ধরে রেখেছেন গ্রামের মানুষ। প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে এবার গুটি খেলা শুরুতে খেলোয়াড়ের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম হলেও সন্ধ্যায় হাজারো খেলোয়াড়ের ঢল নামে।
করোনার কারণে স্থানীয় প্রশাসন বাধা দিলেও তা উপেক্ষা করেই বেলা আড়াইটায় কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। অন্য বছরের তুলনায় এবারের খেলায় খেলোয়াড়ের উপস্থিতি ছিল কিছুটা কম।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল ছিদ্দিক জানান, গুটি খেলার আয়োজকদের ডেকে এবারের খেলা করোনার কারণে না করতে বলা হয়েছিল।
খেলা শেষ হতে দুই থেকে তিন দিন সময়ও লাগে। সর্বোচ্চ টানা ১০দিনও বিরতিহীনভাবে এই খেলা চলার নজির রয়েছে।