আজকের অগ্রবাণী ডেস্ক | ২৯ জুন ২০১৮ | ৮:২৫ অপরাহ্ণ
রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো ‘বঙ্গদেশে কামাল আতাতুর্ক: ইতিহাস, রাজনীতি ও সাহিত্য’ শীর্ষক ৩০৯তম সাপ্তাহিক পাবলিক লেকচার।
শুক্রবার (২৯ জুন) বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের একটি সভাকক্ষে এ লেকচারে প্রবক্তা ছিলেন সাহিত্যিক এবং সাবেক তুর্কি বুর্সলারি স্কলারশিপ ফেলো ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সরোজ মেহেদী।
তিনি তুর্কিদের জীবন ব্যবস্থা, তুর্কি বিপ্লব, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী মানসে তার প্রভাব নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য রাখেন।
উপস্থাপিত প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন ভাষাবিজ্ঞানী ও রবীন্দ্র গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কবির, চ্যানেল আই’র সিনিয়র রিপোর্টার মাশরুর শাকিল, রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের হেড অব কমিউনিকেশন ইফতিখারুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন হাসান আহমেদ খান, জামসেদ সাকিব প্রমুখ।
রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের সভাপতি আরিফ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাকিবুল ইসলাম রবিন। ট্রাস্টের গবেষণা ও অনুবাদ বিভাগের প্রধান রাশেদ রহমান এতে সমাপনী বক্তব্য রাখেন।
সরোজ মেহেদী বলেন, ১২০৪ সালে তুর্কি বংশোদ্ভূত বখতিয়ার খিলজীর হাত ধরে বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের শাসন পর্ব শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে তুরস্কে গোড়াপত্তন হয়েছিল উসমানীয় খেলাফত শাসনের। বাঙালি মুসলমান ও তুর্কি মুসলমানের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্কের শুরু সে সময় থেকেই। যা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখনো অটুট রয়েছে। বাঙালি মুসলমান যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করছে তখন স্বাধীন ও সার্বভৌম অটোমান সাম্রাজ্য ছিল তাদের অনুপ্রেরণা। এ অঞ্চলের মুসলমানরা অটোমান শাসকদের ইসলাম ধর্মের গার্ডিয়ান বা শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নানা কারণে অটোমান সম্রাট সাম্রাজ্য হারানোর পর্যায়ে পৌঁছালে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের রক্ষায় আন্দোলন শুরু হতে দেখি। যা খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত। তবে ১৯২৪ সালে তুর্কি বীর মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক (১৯ মে ১৮৮১-১০ নভেম্বর ১৯৩৮) নিজ দেশে খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করলে ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা খেলাফত আন্দোলন আপনাআপনিই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।বক্তব্য রাখছেন সাহিত্যিক ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সরোজ মেহেদীএ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, দীর্ঘ ৬শ বছরের অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পুরো মুসলিম বিশ্বে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হন মোস্তফা কামাল। তার আনা সংস্কার অন্য অনেক দেশের মুসলমানদের মতো বাঙালি মুসলমানদের অনেকেও মেনে নিতে পারেননি। তবে কামালের সমর্থনে বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অনেকে এগিয়ে এলে অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে।
‘কামালের সমর্থনে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রধানতম। নজরুলের একাধিক কবিতা ও প্রবন্ধে তার প্রকাশ ঘটে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো বিদ্রোহ ঘোষণা করা কবি নজরুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো বুঁদ হয়ে থাকেন আতাতুর্কের বীরত্বে। লেখক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার মতে, “তুর্কি সমাজের জন্য মোস্তফা কামাল যা করেছিলেন, নজরুল আন্তরিকভাবে বাঙালি মুসলমানের জন্য অনুরূপ কিছু করার বাসনা পোষণ করতেন।” নজরুলের পাশাপাশি কামাল পাশার সমর্থনে যিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন তিনি প্রখ্যাত সাহিত্য-চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদ। ঢাকায় ১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে ‘মুসলিম সাহিত্য পরিষদ’ নামক একটি সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে কাজী ওদুদ ‘মুস্তফা কামাল সম্পর্কে কয়েকটি কথা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি মুস্তফা কামালের ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। কামালের এ বিপ্লব সারাবিশ্বের মুসলিম সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানকে দেখা যায় কামালকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে এ অঞ্চলে অনুরূপ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে।’
সরোজ মেহেদী জানান, প্রথম দিকে দ্বিধাগ্রস্থ থাকলেও পরবর্তী সময়ে মুসলিম পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখা লেখক ও কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে দেখা যায় মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে, এমনকি পাশার জন্য অর্থ সাহায্যও পাঠান তিনি। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, শিক্ষাবিদ শামসুল হুদা, ঔপন্যাসিক আবুল ফজল, আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রমুখ কামাল আতাতুর্কের সংস্কারবাদের সমর্থনে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। ‘কামাল পাশা’ শিরোনামে একটি নাটক লিখেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ। নারী অধিকার আন্দোলনের প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের চিন্তা ও চেতনা গভীরভাবে কামাল দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
‘তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলন ও তুর্কি বীর কামাল আতাতুর্কের বীরত্ব বাঙালি মুসলমানের মধ্যে আলোড়ন জাগালেও বাঙালি হিন্দুর মধ্যে এর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। তবে একেবারে ছিল না তা বলার সুযোগ নেই। তবে কামালের মৃত্যুর পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি কলাম লেখেন। যেখানে পাশার প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ পায়।’
ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ এনামুল হকের বরাত দিয়ে সরোজ মেহেদী বলেন, ১৯৩৮ সালে পাশার মৃত্যুর খবরে এ অঞ্চলের হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে শোক প্রকাশ করেন। অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। এ দৃশ্যের মধ্য দিয়ে এ কথা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, পাশা ও তার দেশের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে কামাল পাশা হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির একজন আপনজন।