নিজস্ব প্রতিবেদক: | ০৩ আগস্ট ২০১৭ | ৯:৩০ অপরাহ্ণ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির একজন দেশবরেণ্য রসায়নবিদ। বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের কাছেই জনপ্রিয় এ শিক্ষক । বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে সফলভাবে দীর্ঘ ৫ বছর দায়িত্ব পালন করে । তিনি ২০১৭ সালের ২ই আগষ্ট নিজ বিভাগে যোগদান করেন।
জানা যায়, দেশবরেণ্য রসায়নবিদ অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির ১৯৫৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সাতাশিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব-কৈশোরের সময় গুলো কেটেছে জাতির জনকের পূণ্যভূমিতে। ছোট বেলা থেকেই অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে লালন করেই তিনি বেড়ে ওঠেছেন। জন্মের কয়েক বছরের মাথায় বাবাকে হারিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন। মায়ের স্নেহ ভালোবাসার মাঝে তিনি বেঁচে থাকার নতুন অনুপ্রেরণা খুঁজে পান। বাবা সবসময় চাইতেন ছেলে পড়ালেখা করে তার মুখ উজ্জ্বল করুক। বাবার সেই স্বপ্নকে তিনি ছোট বেলা থেকেই নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছেন।
শরীফ এনামুল কবিরের শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামের অন্য আট-দশটা সাধারণ ছেলের মতোই। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন-যাপন করতে বেশ পছন্দ করেন। গ্রামের মাটির রাস্তা, বর্ষার কাদা-পানি এসবের ভেতর দিয়েই তাকে স্কুলে যেতে হতো। হাইস্কুলে যেতেন নৌকা বেয়ে, প্রায় আড়াই মাইলের মতো পথ নৌকা বেয়ে স্কুলে যেতে হতো তাকে। ছাত্র জীবন থেকেই তার বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল।
স্কুল জীবনে প্রথমে তিনি মানবিক শাখার ছাত্র ছিলেন। স্কুল জীবন শেষে রাজেন্দ্র কলেজে তিনি এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এইচএসসির গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় ব্যাচের এবং রসায়ন বিভাগের ২য় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই তিনি জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। স্নাতকে অধ্যয়নরত অবস্থায় গবেষণার ঝোঁক মাথায় চেপে বসে শরীফ এনামুল কবিরের। এরপর তিনি স্নাতকোত্তর থিসিসসহ প্রথম স্থান অধিকার করেন। এটিই তাকে বিজ্ঞান চর্চায় আরো বেশি অনুপ্রাণিত করে।
নিজ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তিনি ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে কমনওয়েলথ স্কলার হিসাবে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি জাহাঙ্গীরনগরে অর্গানোমেটালিক ও ক্লাস্টার রসায়নের উপর গবেষণা শুরু করেন। তিনি আমেরিকা, ইল্যান্ড, সুইডেন ও জার্মানিতে একাধিক পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। ভিজিটিং স্কলার হিসাবে তিনি ক্যালিফর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি নর্থ রিজে এ জে ডিমিং এর তত্ত্বাবধানে প্রফেসর এডওয়ার্ড রোজেনবার্গ ও প্রফেসর কেনেথ হার্ড-কাসলের সঙ্গে যৌথ গবেষণা করেন। ১৯৯৪ সালে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসাবে মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এডওয়ার্ড রোসেনবার্গের গ্রুপে যোগদান করেন। অ্যালেকজান্ডার ফন হামবোল্ট স্কলার হিসাবে তিনি প্রফেসর হেনরি বারেনক্যাম্প-এর সঙ্গে ফ্রাইবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন। এরপর তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিটিং প্রফেসর হিসেবে দুই বছর অধ্যাপনা করেন।
সারা দেশে যে কয়জন প্রথিতযশা রসাযনবিদ আছেন তাদের মধ্যে অনন্যসাধারণ অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির। তিনি বাংলাদেশের মোস্ট-সাইটেট রসায়ন গবেষক। গবেষণার জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে সুপরিচিত। রসায়ন বিষয়ে তার বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ দেশের বাইরের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যায়ে পড়ানো হয়।
তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের ৩২০টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এ পর্যন্ত এমএসসি, এমফিল, পিএইচডি পর্যায়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি সৃজনশীল কাজেও বেশ পারদর্শী। বিজ্ঞানের বাইরেও তিনি ‘প্রগতির মহাসড়কে বাংলাদেশ’ ও ‘প্রগতির মহাসড়কে বাংলাদেশের শিক্ষা’ শিরোনামে দুটি বই লিখেছেন। এছাড়াও দেশের জাতীয় পত্রিকা গুলোতে তার কলাম নিয়মিত ছাপা হয়।
বিজ্ঞানচর্চায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশবরেণ্য এ রসায়নবিদ বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সাইন্স এবং এমওগণি গোল্ড মেডেল লাভ করেছেন। ১৯৯০ ও ২০১১ সালে তিনি রসায়নে গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। অতি সম্প্রতি তিনি বিজ্ঞান গবেষণায় অনন্য অবদানের জন্য ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ৭ম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক লাভ করেন।
গবেষণা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ বারের ট্রেজারার, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি, সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য এবং ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবেও। বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সাইন্স, বাংলাদেশ ক্যামিকেল সোসাইটি, রয়েল সোসাইটি অব কেমেস্ট্রির ফেলো হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ এর প্রতিষ্ঠাতা।
নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, প্রজ্ঞা, ভালাবাসা ও অভিভাবক সুলভ ব্যবহার দিয়ে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির তাদের কাছে যেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ যাবৎ কাল পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক। তিনি ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীন সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ যাবতকাল পর্যন্ত অন্য কোন ভাইস চ্যান্সেলরের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞান গবেষণার দ্বার উন্মোচনের লক্ষ্যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্ববৃহৎ ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্দ্যোগ হাতে নেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করে। এরপর আরো অনেক ভাইস চ্যান্সেলর আসলেও তারা কেউই এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। এছাড়া র্যাগিং নামক ভয়াবহ ব্যাধি থেকে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়কে বের করে আনেন। তার সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা ও গবেষণায় একটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার একগুচ্ছ কথা মালায়।