অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ | ১০ নভেম্বর ২০১৭ | ৭:০৬ অপরাহ্ণ
নিষ্ঠুরতা কি সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে ? তা না হলে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটছে কেন? আমরা কি ক্রমেই এক নিষ্ঠুর সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি – যেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া মায়া, মমতা জাতীয় শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই! তার জায়গা দখল করে নিয়েছে অনৈতিকতা, অমানবিতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ জাতীয় সব নেতিবাচক শব্দের কালো হাত। প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন অনেক খবর আসে, যা দেখলে যে কোনো সভ্য মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ার কথা।
কিন্তু সমাজের হৃদয়ে কোনো রক্তক্ষরণ আছে কি? মানুষের অসহিষ্ণুতা যেন ক্রমেই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। সমাজের এই অধঃপতনের শেষ কোথায়? এর জন্য দায়ী কে? এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? বারবার হুশিয়ার করা হয়েছে, অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া, ক্ষমতাশালী প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, সমাজকে ক্রমেই অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাস্তবে তাই ঘটছে এখন। অপরাধ সমাজকে ক্রমেই গিলে খাওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। স্বার্থান্ধ রাজনীতি তাকে আরো উসকে দিচ্ছে। এখন বাঁচাতে হলে সমাজকেই এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সুমতিও বড় বেশি কাম্য।
বর্তমান সময়ে সামাজিক অপরাধগুলো মাত্রা অতিক্রম করতে চলেছে। এ অবস্থায় এখনই লাগাম টেনে ধরা না গেলে আগামী দশ বছরে ভয়াবহ রূপ নেবে সামাজিক অপরাধ। দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মতো দানা বাঁধছে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। আর নীতি-নির্ধারক মহলের অবহেলা আর নজরদারির অভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার ব্যক্তিদের প্রাণহানির ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
অর্থের প্রতি অতি লালসা এবং শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষ সব মানুষের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসহীনতা, সামাজিক উন্নয়নে পদক্ষেপ না নেয়া, বিষন্নতা ও মাদকাসক্তি, রাষ্ট্রের উদাসীনতা ইত্যাদি। আরও লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, কার্যকর বিচার ব্যবস্থার অভাবে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
সামাজিক অপরাধের পেছনে বিষন্নতা দায়ী। দেশে বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ মাুনষ অতিমাত্রায় বিষন্নতায় আক্রান্ত। বিষন্নতা থেকে যদি তাদের ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে সামাজিক অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
বর্তমান সময়ে আমাদের পরিবারগুলোতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার চর্চা কতটা হয়? দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সম্পর্ক সূত্রে ও কর্মকাণ্ডে নৈতিক মূল্যবোধ কতটা রক্ষিত হয়? এছাড়া পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কতটা সতর্ক? পরিবার তো শুধু খাওয়া ও শোওয়ার জায়গা নয়, এর চাইতে আরো নেশি কিছু। এ বিষয়ে সচেতনতার অভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাড়তে থাকে অভিযোগের মাত্রা। এখান থেকেই উৎপত্তি হয় ক্ষোভ, বিষন্নতা, বিশ্বাসহীনতা। পরিবারের সদস্যরাই সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে তাদের মানসিকতা ও কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন ঘটে।
সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাবে পরিবারের সদস্যদের একের প্রতি অন্যের মমত্ববোধ হ্রাস পাওয়ায় ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে আপনজনের প্রাণ কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এমন পরিস্থিতির অবসান জরুরি। আমরা ক্রমক্ষয়িষ্ণু ভঙ্গুর অবক্ষয়গ্রস্ত ও অসুস্থ সমাজে বসবাস করছি। অসভ্যতা নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার ঘেরাটোপে এই সমাজ আজ বন্দি। যার প্রধান শিকার এখন নারী। এই অবক্ষয়ের আরেক চিত্র ইদানীং সমাজে শিশুহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়া। আমাদের কোমলমতি শিশুরা কোনো দিক থেকেই এখন আর নিরাপদ নয়। তারাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এই সমাজে বাবা বছরের পর বছর ধর্ষণ করেছে নিজের মেয়েকে। যদিও বাবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তাতে কী? পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গাটি যে ধসে পড়ল, তার জবাব দেবে কে?
চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় চলছে, চলছে তারুণ্যের অবক্ষয় এর কি কোনো প্রতিষেধক নেই? যারা সমাজকে যারা কলুষিত করছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। যে করেই হোক সামাজিক সুস্থতা আনতে হবে। এ ধরনের অবক্ষয়কে প্রতিরোধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে। এ জন্য ব্যাপকভাবে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এটা রোধ করা যাবে না।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম এবং প্রধান সম্পাদক দৈনিক আজকের অগ্রবাণী।
e-mail: advahmed@outlook.com