অধ্যক্ষ সুমনা ইয়াসমিন | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ৯:৩৭ অপরাহ্ণ
নারী শিক্ষায় অগ্রগতির ক্ষেত্রে রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গেলেও শিক্ষার অগ্রগতিতে গত এক দশকই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। শিক্ষায় প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় নারীর অর্জন বাংলাদেশ ছুঁয়েছে নতুন মাইলফলক।
নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আজ কোনো সন্দেহ নেই। নারীরা দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক। তাই এ নারীদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না। তাই জাতিকে উন্নতি করতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। নারীর ভূমিকা মা হলে ও রাষ্ট্রেয় ও অর্থনীতিতে ব্যবসার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আজ নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পুরুষের সাথে নারী কল কারখানায়, মাঠে কাজ করছে। নারীরা এখন প্রধানমন্ত্রীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। তাই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয় অপরিসীম।
একজন সুশিক্ষিত মাতা জন্ম দিতে পারে একজন সুশিক্ষিত সন্তান। মায়ের কাছ থেকে তারা আচার আচরণ, আদব কায়দা ইত্যাদি শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। তাইতো শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের প্রভাব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”
তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রাথমিকে মোট ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থীর ৫৪ শতাংশের বেশি ছাত্রী। এইচএসসি পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমতা প্রায় প্রতিষ্ঠার পথে। ওই স্তরে ছাত্রীর অংশগ্রহণের হার ৪৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি পরীক্ষার পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, অংশগ্রহণেই শুধু বেশি নয়, সফলতায়ও নারীর হার বেশি। সর্বোচ্চ সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক থেকেও ছাত্রী বেশি।
বিভিন্ন ধারার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রফেশনাল, কারিগরি ও শিক্ষক শিক্ষায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে মাদ্রাসা শিক্ষায় ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর অংশগ্রহণ ১০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে মাদ্রাসার মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি ছাত্রী। উচ্চ শিক্ষায়ও দিন দিন বাড়ছে নারী। এই স্তরে বর্তমানে ৩২ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছাত্রী। এছাড়া শিক্ষক শিক্ষায় নারীর হার ৪০ দশমিক ৬১ শতাংশ, কারিগরি ও ভোকেশনালে ২৪ শতাংশ, প্রফেশনাল শিক্ষায় ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ইংরেজি মাধ্যমে ছাত্রীর হার ৩৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
নারী জাতির মেধা, মননশীলতা, বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষায় ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছেন। কেননা, তিনি মনে করতেন, নারীকে শিক্ষাবঞ্চিত রেখে যেমন আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি শিক্ষিত জাতি গঠনে এবং পারিবারিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করার জন্য মেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করা অনস্বীকার্য। নবী করিম (সা.) স্বয়ং নারীদের বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নারীদের উদ্দেশে শিক্ষামূলক ভাষণ দিয়ে উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’
তবে সমাজে সচেতনতা বাড়লেও এখনও নারীর প্রতি বৈষম্য আছে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র কন্যাশিশুর নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান। দেশে নতুন করে বাল্যবিবাহের প্রকোপ বেড়েছে। বাল্যবিবাহের নানা কারণের একটি নিরাপত্তাহীনতা। নারী প্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে ধর্ষণ, নিগ্রহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে চলার পথে নিরাপত্তাহীনতা, সাইবার ক্রাইম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নামধারীদের হাতে ছাত্রী নিগ্রহ, চাকরিতে প্রবেশে বৈষম্য, অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের ঘাটতি ইত্যাদি অন্যতম। এসবের কারণ খুঁজে প্রতিকার ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ক্লাসরুমে পাঠদান নিশ্চিত হলে কোনো ছাত্রীকে শিক্ষকের বাসায় যেতে হবে না। সে ক্ষেত্রে ছাত্রীর নিরাপত্তার শঙ্কা কিছুটা কমবে।
পরিশেষে বলছি, পুরুষ কখনো একাকী উন্নতির শিখরে আহরণ করতে পারবে না। তাই নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ বন্ধ করে নারীর শিক্ষা গ্রহণের পথকে সুগম করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সচেতন করতে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, উত্তরা ইউনাইটেড কলেজ ও সভাপতি স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ ঢাকা মহানগর উত্তর।