মানিক মুনতাসির | ২৮ মার্চ ২০১৭ | ১০:১৬ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী মুসলিম। আর এর চেয়েও সত্য কথা হলো- এ দেশের প্রায় শতভাগ মানুষই ধর্মভীরু। এমন কি যারা ধর্মীয় কানুন মেনে চলেন না অর্থাৎ নামাজ পড়েন না, রোজা রাখেন না, তারাও ধর্ম নিয়ে কটুক্তি সহ্য করেন না। আর ধর্মের নামে ধর্মান্ধরা (জঙ্গি) যা করছেন, তা তো পৃথিবীর কোনো মানুষই পছন্দ করেন না। তবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার বা জঙ্গিবাদের মদদদাতা নিয়ে নানা বিতর্ক হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এসব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে দল-মত এবং রাজনীতি ভুলে গিয়ে প্রত্যেকেরই উচিত জঙ্গিবাদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। দেশের মানুষ সে অবস্থান নিয়েছেও। এজন্য জঙ্গিবাদ শুধু নিয়ন্ত্রণই নয়, জঙ্গিবাদ নির্মূল করা অত্যন্ত জরুরি। এই জঙ্গিবাদের থাবাতেই আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকিস্তানেও জঙ্গিবাদ নিয়ে চলছে অরাজকতা। একই পথে হেঁটেছে আরও অনেক দেশ। যদিও এই জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। বলা হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং বোকোহেরেমের প্রধান পৃষ্ঠপোষকই হচ্ছে আমেরিকা। শুধু তাই নয় এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে যে, অস্ত্রের ব্যবসা ধরে রাখতে এবং বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের চাপিয়ে রাখতে আইএস আর বোকোহেরেমের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় আমেরিকা।
অবাক করা বিষয় হলো- বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে বিশাল বড় বই লেখা যেতে পারে। অনেকে লিখেছেনও। আজ থেকে ২০ বছর আগে কিন্তু জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। সেভাবে বলা যায়, ২০ বছর পরে কি হবে সেটা হয়তো আমরা জানি না। তবে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রত্যাশা থাকা উচিত, এ দেশ যেন জঙ্গিদের ঘাঁটি না হয়। পশ্চিমা কোনো শক্তিই যেন এদেশকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে। ষড়যন্ত্র করলেও তা যেন সফল না হয়। নাফিশের মতো ছেলেরা যেন আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার পাতা ফাঁদে পা না দেন।
তথ্য অনুসন্ধান করে যা পাওয়া গেছে, তাতে ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি। বাংলাদেশ সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের (প্রয়াত) রাজধানীর শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করে একদল দুর্বৃত্ত; এতে গুরুতর জখম হন তিনি। চিৎকার-চেঁচামেচিতে লোকজন এগিয়ে এসে চার দুর্বৃত্তকে পাকড়াও করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ধারালো অস্ত্র। বাকিরা লাপাত্তা হয়ে যায়। ধৃতরা ছিল কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। পুলিশি জেরায় স্বীকার করে, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ-এর সদস্য তারা। ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করা এই জঙ্গি সংগঠনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ এমনকি গোয়েন্দাদেরও তখন স্বচ্ছ কোনো ধারণা ছিল না। তাদের আকস্মিক এমন দুঃসাহসিক অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হতবাক হয়ে যান। ভাবিয়ে তোলে সরকারকেও। সারাদেশের মাদ্রাসা ঘিরে চলে গোয়েন্দা নজরদারি। তবে নজরদারি এড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একে একে বোমা হামলা হয়। লাশ পড়ে, রক্তও ঝরে। সে থেকে লম্বা হতে থাকে হামলার ঘটনা। বইমেলা, ব্লগার, বিদেশি নাগরিক, কূটনৈতিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, শিক্ষক, ধর্মযাজকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ টার্গেটের শিকার হন এসব উগ্রবাদী সংগঠনের।
এরপর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমা হামলা চালায় আরেক জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মোজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের শক্তিমত্তার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়। এ ঘটনায় পুলিশি অভিযানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেফতার হয় জঙ্গি সদস্যরা। এদের প্রত্যেকেই মাদ্রাসার ছাত্র। গোয়েন্দা তথ্যমতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। মাঝে-মধ্যে গ্রেফতার হয় জঙ্গি সদস্যরা। দাবি করা হয় আস্তানা আবিষ্কারের। কিন্তু এই জঙ্গিবাদ আর নির্মুল করতে পারেনি কোনো সরকারই। তবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে নানাভাবে। এর প্রায় ১১ বছর পর ১ জুলাই-২০১৬ রাতে গুলশানে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাপের জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। কয়েক স্তরের নিরাপত্তায় বেষ্টিত কূটনৈতিক এলাকার হলি আর্টিজানে হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
১৯৯৯ থেকে ২০১৭ মাত্র ১৭ বা ১৮ বছরে কি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এসব জঙ্গি সংগঠন। তা হলি আর্টিজান আর সিলেটের আতিয়া মতহলের ঘটনা না ঘটলে হয়তো জানাই হতো না। শুরুর দিকে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী বা জঙ্গিরা ছোরা-চাকু-চাপাতি নিয়ে হামলা করত। আর এখন বোমা, পিস্তলসহ আধুনিক আগেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করছে। পরিবর্তন ঘটেছে জঙ্গি তৎপরতার সর্বক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে জঙ্গি তৎপরতা রোধ করা যাদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের এই পরিবর্তন ধরতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের নির্মুল করতে একের পর পুলিশ, র্যাবসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন দেশকে ভালোবাসে। সত্যিই তারা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য, তারাই তো এ যুগের শ্রেষ্ঠ বীর। যারা দেশ থেকে জঙ্গিবাদের কালিমা মুছে দিতে একের পর জীবন দিয়ে যাচ্ছেন।
আজকাল আরেকটা বিষয়ে খুব অবাক হচ্ছেন দেশবাসী, আর তা হলো- জঙ্গিবাদ বা ধর্মান্ধদের শ্রেণি দেখে। আগে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছেলেরা এসব অপকর্মে লিপ্ত হতো। যাদের প্রায় সবারই পরিবারের আয়-রোজগার বলতে কিছু ছিল না। সেই সূত্র ধরে গোয়েন্দারাও নজরদারি করতে মাদ্রাসাগুলোতে। কিন্তু এখন জঙ্গি তৎপরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা বিশ্বাস করা কঠিন। যা জেনে অনেকেই আঁতকে উঠেন। হলি আর্টিজানের হামলায় যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকেই দেশ-বিদেশের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। শুধু তাই নয়, এরা প্রত্যেকেই সোনার চামচ মুখে জন্ম নেওয়া। এরা জীবনে অভাব কাকে বলে হয়তো সে শব্দটিই জানতেন না।
সেই ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে জঙ্গি বা জিহাদি সংগঠনের জন্মদাতা মুফতি হান্নানরাও এখন প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। যারা কিনা জান্নাতে যাবার জন্য মুখিয়ে থাকেন তারাই আবার প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গিরা সেদিন চিৎকার করে বলেছেন ‘আমাদের হাতে সময় কম, সোয়াত পাঠান তাড়াতাড়ি’। অর্থাৎ তারা হামলার ঘটনা ঘটিয়ে আত্মহুতি দিবেন যা তাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবে! আর তাদের পথ পদর্শক মুফতি হান্নানরা জেলে বসে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। এটা বেশ খটকা লাগারই বিষয়। তাদের আদর্শ কি? তাদের চাওয়া কি? আসলে তাদের প্রকৃত কোনো আদর্শ নেই। কোনো ধর্ম নেই। কোনো অন্ধবিশ্বাসই যাদের বিশ্বাস। এই ধর্মান্ধদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে আগামী প্রজন্মকে। বাঁচাতে হবে এই দেশকে। এদেশের ১৬ কোটি জনগণকে। ফলে নিয়ন্ত্রণ নয়, এদের নির্মূল করাই হোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একমাত্র এজেন্ডা। আর সফল হোক সেই এজেন্ডা। বেঁচে থাকুক স্বপ্ন। বেঁচে থাকুক সোনার বাংলাদেশ। প্রস্ফুটিত হোক আমাদের সোনালী ভবিষ্যৎ।