ইঞ্জিনিয়ার এম এম আবুল হোসেন | ০৪ জুলাই ২০১৭ | ৪:০৪ অপরাহ্ণ
পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। এ বছরের জুন-জুলাই নাগাদ সেতু দৃশ্যমান হবে। বাকি অর্ধেক কাজ নির্ধারিত আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। শুধু যোগাযোগই নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মা সেতু দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াবে অন্তত ১ দশমিক ২ শতাংশ। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি কোম্পানি, দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীসহ কয়েক হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করছে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালেই যান চলাচলের জন্য বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া যাবে আশা করা হচ্ছে।
যোগাযোগের মাধ্যম যত উন্নত ও দ্রুততর হবে, ততই মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। এটি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার আয় বাড়াবে এবং নতুন নতুন কাজের জোগান দেবে। আমাদের বিশ্বাস, প্রায় আট কোটি লোকের সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনবে এই সেতু। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণই যথেষ্ট নয়, অন্যান্য ছোট ছোট খাল ও নদীর ওপরও যদি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হয়, তাহলেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। আমাদের বিশ্বাস, উৎপাদিত খাদ্যশস্য এবং পণ্য বাজারজাতকরণে দ্রুত উন্নতি ঘটাবে এই সেতু। ফলে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য আর নদীতে বা রাস্তায় ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। অন্যদিকে শহর থেকে গ্রামের মানুষের জন্য যেসব দ্রব্য আশু প্রয়োজন সেগুলো দ্রুত পরিবহন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া মুমূর্ষু রোগীরা ঢাকায় এসে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবে। দক্ষিণাঞ্চলের টাটকা মাছ তখন ঢাকা শহরেই পাওয়া যাবে। এতে মাছের উৎপাদনও বাড়তে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়া একান্ত প্রয়োজন ছিল, যা বর্তমান সরকার করছে। রেললাইনসহ পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জন্য সমগ্র বাংলাদেশ অনেক কাছের হয়ে যাবে। এখন লঞ্চে দক্ষিণবঙ্গে যেতে এক দিন এক রাত লেগে যায়। সেতু তৈরি হলে সেই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। জনগণের জন্য যা কল্যাণকর তা বাস্তবায়নে দলমত-নির্বিশেষে প্রত্যেকের সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিত। ১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০০১ সালে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর অর্থের জন্য নানা জায়গায় দেনদরবার চলতে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে অর্থায়নের আগ্রহ দেখায়। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। তবে প্রথম থেকে সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৩ সালে। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায়। এরই মধ্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি এ ইস্যুতে সরকার নৈতিক বিজয় লাভ করে- যখন দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত জানায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পদ্মা সেতুর সুফলের আওতা বাড়াতে এর ওপর দিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে রেললাইন। এর অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আলোকিত বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নড়াইলসহ নতুন পাঁচ জেলা রেলওয়ের সেবার আওতায় আনা হবে। এর আগে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, এ অঞ্চলগুলোয় অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা হবে। সরকারের এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।
অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিতব্য সেতুটি দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প হিসেবে গণ্য। এ সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু যুগান্তকারী অগ্রগতিই সাধিত হবে না, অধিকন্তু অর্জিত হবে জাতীয় আস্থা ও সক্ষমতা। এটা সুবিদিত, অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম মূল ভিত্তি হলো যোগাযোগব্যবস্থা। সেইসঙ্গে কার্যকর পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগ। অর্থাৎ উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কিত কতগুলো বিষয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে যোগাযোগ উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি যুক্ত করলে অর্থনীতিতে দ্রুত ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক অতি নিবিড়। বলা হয়ে থাকে, যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটলে একটি অঞ্চলের অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু আমাদের দেশের পশ্চাৎপদ উত্তরাঞ্চলকে আলোকিত করার কাজে ভূমিকা রাখছে। দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে সব মঙ্গাপীড়িত ও অবহেলিত জনপদের যোগাযোগ সহজলভ্য করেছে। পশ্চাৎপদ এলাকার মানুষ প্রতিযোগিতার কর্মধারায় বাংলাদেশের উন্নয়নে শরিক হচ্ছে। কৃষি, শিল্প সব মিলিয়ে সেখানে সেতুটি উন্নয়নের একটি আলাদা মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থায় অচলাবস্থা থাকলে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়। ভারসাম্যহীন অর্থনীতি অসম যোগাযোগ অঞ্চলে সমানভাবে বিকশিত হতে পারে না। যোগাযোগ সাবলীল করা গেলে কৃষি উন্নয়ন, শিল্পে সম্ভাবনা, আইনশৃঙ্খলার সুষম প্রয়োগ এবং সামাজিক উন্নয়নের সিংহদ্বার খুলে যায়। তাই বাংলাদেশকে এক ও অভিন্ন অর্থনৈতিক চাকায় উঠাতে হলে শুধু পদ্মা সেতু বা বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। প্রয়োজনে এ রকম আরো বহুমুখী সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নয়নের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সেই সঙ্গে সারা দেশে সব উন্নয়নের দিকেও জোর দিতে হবে।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।