ইঞ্জিনিয়ার এম এম আবুল হোসেন | ১৭ জুন ২০১৭ | ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ
চট্টগ্রাম বন্দরনগরী ও পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড় ধসে চার সেনা সদস্যসহ অন্তত ১৫৬জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। আহতের সংখ্যা ৬৫। পাহাড় ধসে শুধু রাঙামাটিতেই শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে। দেশের পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানি সাংবার্ষিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
গত এক দশকে এতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সাড়ে তিনশ জন। এর মধ্যে সোমবার মধ্যরাত ও মঙ্গলবার ভোরে প্রাণহানি ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। পাহাড় ধস পাহাড়ি এলাকার একটি সাধারণ ঘটনা। তবে আমাদের দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি ধসে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ধসের অন্যতম প্রধান কারণ অতিবৃষ্টিজনিত পাহাড়ি ঢল। পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন এবং গাছপালা উজাড় করার অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডও এ জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। পক্ষকাল আগে ঘূর্ণিঝড় মোরার কারণে পাহাড়ি এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। টানা বৃষ্টিপাতে বালুর পাহাড় নরম হয়ে যায়। পাহাড়ি ঢলে গাছপালাহীন ন্যাড়া ও কাটা পাহাড় ধসে যায়। পাহাড় ধসের খবর পেয়ে সেনা সদস্যরা উদ্ধার কাজ চালানোর সময় ধসের কবলে পড়ে দুই অফিসারসহ চার সেনাসদস্য প্রাণ হারান। পাহাড় ধসে প্রাণহানি সাংবার্ষিক ঘটনায় পরিণত হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। লক্ষণীয়, নিহতের সিংহভাগ বহিরাগত।
পাহাড়ের যেখানে সেখানে ঘর তুলে বসবাসের প্রয়াস তাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। পাহাড় ধসে সবুজ নিসর্গের জনপদ রাঙামাটি বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। শতাধিক মানুষের বেঘোর মৃত্যু রাঙামাটির প্রাণচাঞ্চল্যকে কেড়ে নিয়েছে। পাহাড়ি বাঙালি দুই সম্প্রদায়ই শোকে আচ্ছন্ন। পাহাড়ি ঢলে ধস নামায় চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে এক বা দুই মাস সময় লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ধসের ফলে সড়কে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে তা অপসারণের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা করছে পাহাড়ি বাঙালি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ।
মানুষ মানুষের জন্য এ সত্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পাহাড় ধসের ত্রাণ কাজে। পাহাড়ে অনিয়ন্ত্রিত বসতি গড়ে তোলা, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, গাছপালা নিধন এবং অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে পাহাড় ধসের বিপর্যয় নেমে আসছে। বারবার মৃত্যু হানা দিচ্ছে পাহাড়ের ঢালে বসত করা গরিব মানুষদের দিকে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
পাহাড় ধসে মৃত্যু সাংবার্ষিক বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও এবারের পাহাড় ধস অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ছবির মতো সাজানো জনপদ রাঙামাটিকে যেন এবড়ো-থেবড়ো করে দিয়েছে কোনো ভয়াল দৈত্য। রাঙামাটি শুধু নয়, পার্বত্য তিন জেলায় এমন বিপর্যয়কর ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি। মাত্র ক’দিন আগে লংগদু উপজেলায় এক বাঙালি যুবকের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলেও পাহাড় ধসের ঘটনায় দুই সম্প্রদায়কে যেভাবে একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে তা এক আশাজাগানিয়া ঘটনা। বাঙালি পাহাড়ি একে অন্যের জন্য যেভাবে ছোটাছুটি করছেন, একে অন্যের শোকে যেভাবে কাঁদছেন তাতে পাহাড়ি এলাকার হৃদয়ের প্রতিছবিই যেন ফুটে উঠেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংকীর্ণতাকে হটিয়ে মানবিক সত্তাকে সামনে আসতে সাহায্য করেছে। এ সম্প্রীতি বহাল থাকলে পাহাড়ি এলাকার পুনর্বাসন যেমন দ্রুততর করা সম্ভব হবে তেমন গড়ে উঠবে সম্প্রীতির পরিবেশ। আমরা আশা করব নিজেদের স্বার্থেই পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী পাহাড়ি বাঙালি সব সম্প্রদায়ের মানুষ সম্প্রীতির এ পরিবেশকে যে কোনো মূল্যে এগিয়ে নেবে।
পরিশেষে বলছি, পাহাড়ি ধস থেকে মানুষের প্রাণ রক্ষায় পাহাড়ের গাছপালা নিধন ও পাহাড় কাটার অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। বিপজ্জনক এলাকা থেকে বসতি সরিয়ে ফেলার জন্য নিতে হবে উদ্যোগ। চট্টগ্রাম ও দুই পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ পাহাড়ি ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী উদ্ধার কাজ সম্পর্কে সার্বক্ষণিকভাবে খোঁজখবর রাখছেন। প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব পাহাড় ধসের ট্র্যাজেডি এড়াতে সতর্কতা অবলম্বনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে পাহাড়ি জনপদের স্থানীয় সরকার, সরকারি প্রশাসন এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সক্রিয় হতে হবে। মানুষের অসহায় মৃত্যু রোধে নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।