অনলাইন ডেস্ক | ২৯ এপ্রিল ২০১৭ | ৯:২৩ অপরাহ্ণ
মালয়েশীয় ফল- রামবুটান চাষ করে স্বাবলম্বী নেত্রকোনার কৃষক আলী উসমান। দেখতে লিচুর মতো এই ফলটি খুবই সুস্বাদু। আর তাই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ভালো দামে কিনে নিয়ে যাচ্ছে এই ফল। বাণিজ্যিকভাবে চাষ হলে বিদেশেও এটা রপ্তানি সম্ভব বলে মনে করেন কৃষিবিদরা।
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার আলী উসমান, ১৯৯২ সালে মালেশিয়া থেকে নিয়ে আসেন রামবুটান ফলের চারা। দেখতে লিচুর মতো এই ফল খেতে বেশ সুস্বাদু। পরে শখের বসে বাড়ীর ৪০ শতাংশ জায়গায় রামবুটানসহ বিভিন্ন ফলের চাষ শুরু করেন তিনি।গাছে ফল আসায় এখন বিক্রি শুরু করেছেন। এই ফল ও চারা বিক্রি করে বছরে ২ লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন তিনি। প্রতিকেজি রামবুটান ফল ৩শ’ টাকা দরে কিনে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। এদিকে আলী উসমানকে রামবুটান চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ নতুন চাষীদেরও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। দেশে রামবুটান চাষ বাড়ানো গেলে বিদেশেও তা রপ্তানি সম্ভব বলে মনে করেন কৃষিবিদরা।
বিভিন্ন ধরনের ফলের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২৫ হাজারের বেশি কৃষক ও ফল চাষে উদ্যোগী হয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। পর পর বাম্পার উৎপাদন এবং আকর্ষণীয় মূল্য কৃষক ও সাধারণের মধ্যে ফল চাষে উৎসাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চ মূল্যের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ফলন পাওয়া যায় এমন চাষের ফল চাষ তাদের আগ্রহী করে তোলে। এতে তাদের নিজের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পরেও লাভবান হচ্ছে এবং ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে অত্যন্ত লাভজনক এই ফল চাষে নীরব বিপ্লব সাধনে ফল চাষ আরো সম্প্রসারণে সরকার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি সূত্র জানায়, রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় কৃষক ও উৎসাহী সাধারণ ব্যক্তির বাগান ও বসত বাড়ির ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বার্ষিক ৬৩৮ কোটি টাকা মূল্যের ৮৮ হাজার টন ফল উৎপাদন করছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (ডিএই) হটিকালচার বিশেষজ্ঞ খন্দকার মেসবাহুল ইসলাম বলেন, প্রধানত বেসরকারি খাতে ফলের উৎপাদন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে নীরব বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ইনস্টিটিউট এবং গবেষণা সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এবং ফলের বাগান, বসতবাড়ি ও পতিত জমিতে ফল চাষ সম্প্রসারণে কার্যকর উদ্যোগ অচিরেই ফলপ্রসু হতে যাচ্ছে। কৃষক ও সাধারণ উদ্যোক্তা চলতি বছর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও নীলফামারি জেলায় তাদের বাগান ও বসতবাড়িতে ৩০৮ কোটি টাকা মূল্যের ৭৭ হাজার টন আম উৎপাদন করেছে।
মেজবাহুল ইসলাম বলেন, রংপুর অঞ্চলে বর্তমানে ৫ হাজার বাগানে ৪.৭৫ লাখের বেশি এবং বসতবাড়ি ও সংলগ্ন জমিতে ১২.৫০ ফলবান গাছ থেকে আম পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি এ বছর রংপুর অঞ্চলে বাগান ও বসতবাড়ি থেকে ১৮০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ৯ হাজার টন লিচু উৎপাদিত হয়েছে। রংপুর অঞ্চলে ৩ হাজার বাগানে ২.৫০ লাখ বসতবাড়ি সংলগ্ন ১৫০০ হেক্টর জমিতে ১ লাখের বেশি ফলবান লিচু গাছ রয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকরা বার্ষিক ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার টন কলা, পেঁপে, লটকোন, বড়ই, কাঁঠাল, ব্লাকবেরি, স্ট্রবেরি, জলপাই, বেল, পেয়ারা, পানিফল, বাঙ্গি, আমলকি ও আঙুর এবং অন্যান্য স্থানীয় জাতের ফল উৎপাদন করছে। মেজবাহুল বলেন, পর পর বাম্পার ফলনের পাশাপাশি আকর্ষণীয় বাজার মূল্য পাওয়ায় কৃষক ও সাধারণ উদ্যোক্তারা প্রতিবছর সকল ধরণের ফল চাষ সম্প্রসারণ করছে পাশাপাশি এ অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
আরডিআরএস বাংলাদেশ’র কৃষি ও পরিবেশ সমন্বয়ক মামুনুর রশিদ বলেন, এ অঞ্চলের হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, দরিদ্র পরিবার, দুস্থ মহিলা এবং সাধারণ মানুষ ফল চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে। তিনি বলেন, বাউকুল, আপেল কুল জাতীয় দ্রুত ফলনশীল এবং অন্যান্য ফলের চাষ দ্রুত সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষক তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। ফল উৎপাদক নাসিমুল হক, মমিনুর রহমান ও বুলবুল আহমেদ বলেন, অন্যান্য কৃষক ও সাধারণ আগ্রহীদের মতো তারা উচ্চ মূল্যের দ্রুত ফলনশীল এবং প্রচলিত ফল উৎপাদনের মাধ্যমে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ভিক্ষুক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং সাধারণ লোকরা তাদের বাগান ও বসতবাড়িতে ফল উৎপাদনের তাদের পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে আর্থিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করছেন।
নার্সারি মালিক মোখলেসুর রহমান, আবদুস সোবহান ও আবদুল মালেক বলেন, তাদের নার্সারি থেকে প্রতিবছর প্রচলিত উচ্চ মূল্যের এবং দ্রুত ফলনশীল জাতের ফলের চারা বিক্রির মাধ্যমে তারা লাভবান হচ্ছেন।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার পল্লীতে এই প্রথম অন্যের জমিতে সুস্বাদু ‘স্ট্রবেরি’ ফলের চাষ করে মাটিহাঁস গ্রামের কৃষক রাজধন চন্দ্র স্বাবলম্বী হতে চলেছে। কোন প্রকারে ঝামেলা ছাড়াই সুস্বাদু ‘স্ট্রবেরি’ ফলের চাষ করছেন তিনি।
অণ্যের চাষাবাদ দেখে এফল চাষে তার আগ্রহ হয়। জেলার পীরগাছা থেকে চারা সংগ্রহ করে রাজধন চন্দ্র অন্যের একবিঘা জমি বছর পত্ত্বনি নিয়ে স্ট্রবেরী চাষ করেছেন। নিজের উৎপাদিত চারা না থাকায় সময়মত চারা বপন করতে বিলম্ব হয়েছে। তারপরেও সঠিক পরিচর্যা করায় ফলন এসেছে অনেক বেশি। ফলগুলো বেশ পরিপুষ্ট হয়েছে। শুধু ফল বিক্রি করে কমপক্ষে ৩লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন চাষী রাজধন চন্দ্র।
একান্ত সাক্ষাতকারে চাষী রাজধন চন্দ্র বলেন, পীরগাছা গ্রামে আমার শ্যালকের স্ট্রবেরী চাষ দেখে আমার আগ্রহ হয়। শ্যালকের পরামর্শ নিয়ে পীরগাছার বিশ্বনাথের কাছ থেকে ৬হাজার স্ট্রবেরীর চারা সংগ্রহ করেছি। একবিঘা জমিতে ওই চারাগুলো রোপন করি। চারা ক্রয়, চাষ, রোপন, সেঁচ, নেটজাল ও ক্ষেতের বেড়াসহ যাবতীয় পরিচর্যায় একবিঘাতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ১লাখ টাকা। এআবাদে ইনতেফা নামের জিংক ব্যতিত অন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়না। তিনি আরো বলেন, স্ট্রবেরী চাষে আগ্রহী অনেক চাষি চারা সংগ্রহ করতে আসে। তবে আমি চারা বিক্রয় করছি না।
স্ট্রবেরী ফল বিক্রি করে এপর্যন্ত ১লাখ টাকা আয় হয়েছে। গাছে ফলন এসেছে দ্বিগুন। এছাড়া ফলগুলো অনেক বেশি পরিপুষ্ট হয়েছে। ৩৫/৪০টি ফলে এক কেজি হচ্ছে। তিনি জানান, প্রথম দিকে মাঘ মাসে প্রতি কেজি স্ট্রবেরী প্রায় ৩’শ টাকা দরে বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৮০/১০০টাকা কেজি পাইকারি মূল্যে বিক্রয় করছি। কালিগঞ্জ, আবাদপুকুর, চাপাপুর, গুলিয়া, চাকলমা, হাটকড়ই, পন্ডিতপুকুর, ওমরপুর, নন্দীগ্রামের স্থানীয় হাট-বাজারসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এফলগুলো বিক্রয় করছি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানিয়েছে, স্ট্রবেরীর চারা সাধারণত অগ্রাহায়ন মাসের মাঝামাঝি সময়ে রোপন করতে হয়। চারা রোপনের ৩০/৪০ দিনের মাথায় ফলন আসে। ৩ মাস ধরে ফল তোলা যায়। প্রতিটি গাছে ৩বার ফল ধরে। এক মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই কেজি ফল পাওয়া যায়।
চাষী রাজধন চন্দ্র জানিয়েছেন, তার চাষ দেখে এ উপজেলার অনেক চাষী স্ট্রবেরী চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। স্ট্রবেরী ফল চাষের মাধ্যমে নিজের এলাকার অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোর আশা প্রকাশ করেছেন চাষী রাজধন চন্দ্র। তিনি নিজেরেও ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছেন। তার নিজস্ব কোন জায়গা-জমি না থাকা সত্বেও দু’জন শ্রমিককে প্রতিনিয়ত কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি ও আমার স্ত্রীসহ দু’জন শ্রমিক নিয়ে স্ট্রবেরীর পরিচর্যা করছি।
প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে দিতে হয়। এচাষের পাশাপাশি তিনি টমেটো, শষা ও মরিচ চাষ করছেন। এ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি অফিসার মুহাম্মদ মুশিদুল হক জানান, স্ট্রবেরী চাষী রাজধন চন্দ্রের স্ট্রবেরী ক্ষেত পরিদর্শন করা হয়েছে। স্ট্রবেরী চাষে যাবতীয় পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এউপজেলার কৃষকেরা অত্যন্ত পরিশ্রমি। তারা যেকোন ফসল চাষ একবার দেখেই চাষবাদ করার চেষ্টা করে। অতিকষ্টে হলেও বিভিন্ন চাষে সফল হতে পারে। চাষীরা স্ট্রবেরী চাষে আগ্রহী হলে কৃষি অফিসের সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যহত থাকবে।
এগ্রিকালচার অব বিআরএসি ইন্টারন্যাশনাল’র সহকারি পরিচালক ড. এম এ মজিদ গ্রামীণ অর্থনীতি জোরদারে এবং সফল জাতি গঠনে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটাতে ফল চাষ আরো সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ||
৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ |
১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ |
২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ |
২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |