আসিফ হাসান কাজল | ১৪ মার্চ ২০১৮ | ১১:০৬ অপরাহ্ণ
১৯৮৩ সালে স্কুল ছেড়েছেন,গেল বছর সেই স্কুলের প্রিয় শিক্ষকের নিজ অর্থায়নে বাড়ি করে দিয়েছেন দান বা প্রতিদান নয় ভালবাসার মেরুবন্ধনে।
সেই ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপ এর সুইডেনে। বর্তমানে গ্লোবাল ফার্মাসিটিউকালস এর পরিচালক তিনি। দেশপ্রেমী এই মানুষটির নাম রহমান মৃধা।
অনেক আগেই পিতা মাতা হারা মানুষটির পা দেশের মাটিতে পড়েনি তিন যুগেরও বেশি সময়কাল ধরে! দেশের প্রতি আবেগ আর প্রতিদান দিতে তিনি ভুলেননি।
বিশ্বাস করেন বাঙালী জাতি সুশিক্ষিত হলেই এই গরীব দেশের চেহারা পাল্টাবে, স্বশিক্ষিত জাতিই তো উন্নতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। সে কারনেই (মায়ের দেশ) বাংলাদেশের মাটিতেই প্রতিষ্ঠা করতে চান এক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে নানা মাধ্যমের শিক্ষকসম্প্রদায় এর শিক্ষণ তথা প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষকই তো ভাল বুঝবেন তার নিবিড় পরিচর্চায় এক একটি ছাত্র/ছাত্রীর মধ্যে কোন সুপ্ত মেধা লুকিয়ে রয়েছে! রত্ন নির্নয়ে যেমনটি পাঁকা জহুরী প্রয়োজন ঠিক তেমনি আগামীর প্রজন্মকে এগিয়ে দিতে দরকার এক প্রশিক্ষিত কারিগর। আর এই বিশেষ কারিগর তৈরীতেই প্রয়োজন এক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে হাসফাস করছেন,সুশীল সমাজের মানুষগুলো তখন নিন্দার ঝড়ে টিভি,পত্রিকা,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনায় ব্যাস্ত সময় পার করছেন। এমন সময় হাজার কি.মি. দূরত্ব থাকার পরেও দেশের মাটি ও মানুষের টানে তার দুচোখে জুড়ে শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষালয় থেকে শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি অর্থাৎ সুশিক্ষার উন্নয়নে স্বপ্ন বুনে চলেছেন! উদ্যমী স্বপ্ন কে বাস্তবে রুপ দিতে যে সেতুবন্ধন হিসাবে মনে করছেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত জাতি, তবেই হবে দেশের অগ্রগতি।
দেশের শিক্ষাব্যাবস্থার বিভাজন রয়েছে,রয়েছে নানা মাধ্যম। রয়েছে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, স্কুল থেকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এর উর্ধমান সিঁড়িপথ। প্রতিবন্ধকতা হিসাবে মনে করেন সমন্বয়হীনতার অভাব, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে যেমনটি কলেজ শিক্ষকের যোগাযোগ নেই,তেমনি কলেজ শিক্ষকেরও সংযোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে! আর যোগাযোগবিহীন এ অবস্থার কারনে হচ্ছে না শিক্ষা বিস্তার, আর যে কারনেই জাতি হিসাবে আমরা শিক্ষিত হয়ে চলেছি কিন্তু সুশিক্ষিত হয়েছে কি? বরং রুগ্ন হয়ে চলেছে বলে মনে করেন আমাদের দেশের শিক্ষাখাত।
নেপোলিয়ান বোনাপাটের কথায় ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দিব’ শিক্ষাব্যাবস্থার সনাতনপ্রথার সমাধানে তিনি মনে করেন একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষকই পারেন ছাত্রের অভ্যন্তরে লুকায়িত প্রতিভাকে বের করে আনতে আর যে কারনেই প্রতিষ্ঠা করতে চান – ‘বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয়’ যেটি হবে সত্যিকারের বিশ্বের বিদ্যালয় যেখানে প্রাথমিক শিক্ষক এর মতামত শুনবেন মাধ্যমিকের শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক এর পাশে বসে আলোচনা করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর থাকবেন বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মন্ডলীরা। অর্থাৎ সকল মাধ্যমের শিক্ষকতার পরাগায়ন ঘটবে যার ফলে শিক্ষক যেমনি আধুনিক মানসম্মত শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হয়ে পাঠদানে বৈচিত্র আনবেন তেমনি ছাত্রছাত্রীরা মুখস্ত বিদ্যার বলি না হয়ে জানতে ও শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
বিশ্বায়ন এর এই যুগে শিক্ষা কোন গ্রামীন শিল্প কিংবা শহুরে শিল্পকারখানা হতে পারে না। শিক্ষা সার্বজনীন সকলের জন্য।
শিক্ষকদের পাঠদানের উৎকর্ষতা সাধনে এই দেশেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়।
কেমন হতে পারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপরিকল্পনা? কার্যক্রম সেই কথা তুলে ধরতেই রহমান মৃধা সুইডেন থেকেই জানালেন তার পরিকল্পনার কথা যা অনেকটা এমনই-
১) দেশের সকল কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে সব স্তরের শিক্ষকবৃন্দ প্রশিক্ষন প্রদান ও গ্রহনের একটি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন ।
২) দেশ, বিদেশের বড় বড় কম্পানি বা সংস্থার মালিক বা সিইও , কর্মকর্তা , গবেষক ,রাজনীতিবিদ , বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকবৃন্দ একত্রিত হয়ে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে দেশ বা সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির চাহিদা নিরুপন করবেন এবং তা পুরনের জন্য শিক্ষকদেরকেও তৈরি করা হবে।
৩) প্রয়োজনীয় সুশিক্ষা প্রদান ও আহরণের আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন ,নির্ধারন ও প্রয়োগের জন্য মান সম্পন্ন গবেষনা চালু থাকবে ।
৪) শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি ও যুগোপযোগীকরণে সহায়তা দান করা , শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি জাগ্রত করা, নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা ও কৌশল বৃদ্ধি করা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন থেকে কার্য সম্পাদনের জন্য শিক্ষকদের উৎসাহিত করাহবে। Value of teaching is learning from learners.
এটা পৃথিবীর প্রথম ভিন্নধর্মী একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে সকল শিক্ষকদের জন্য একটা মিলন কেন্দ্র।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এই ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে সকল উদ্যোগী মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
দেশের প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে ” শিক্ষা ও উন্নয়ন ” নামে একটা করে সেল রয়েছে। প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষা দেখাশুনার জন্য জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ্যফিলিয়েটিং কর্তপক্ষ হিসাবে আছে শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামোগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের তেমন ব্যবস্থা তেমন নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পরিদর্শনও করা হয় না। ফলে প্রশিক্ষণ যতটুকু দেওয়া হচ্ছে তারও প্রয়োগ তেমন হচ্ছে না।
দেশে প্রাথমিক শিক্ষাই এখনও পর্যন্ত শক্ত ভিত্তির উপর দাড়াতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষাকে এখনও সর্বজনীন করা সম্ভব হয়নি।এখনও শিক্ষার প্রতিটি স্তর থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়মিত ঝড়ে পড়ছে। এই হার কোন কোন স্তরে প্রায় এক চতুর্থাংশ যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে স্বল্প মেয়াদি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন।স্বল্প মেয়াদী পদক্ষেপের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সুদৃষ্টি কামনা করছিঃ ক)দেশে বিদ্যমান শিক্ষক প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগসহ আধুনিক, যুগোপযোগী শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অবিলম্বে গড়ে তুলতে হবে। খ) সকল স্তরের শিক্ষকবৃন্দের নিয়মিত ও কার্যকর প্রশিক্ষনের জন্য আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। গ) মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধানের জন্য আরও কার্যকর ও জবাবদিহিমুলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। তার জন্য সরকারি কর্মকর্তা, সুধীজন, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদবৃন্দ, বিভিন্ন শিল্প সংস্থার কর্ণধার বা জনবল রিক্রুটিং সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন করে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। ঘ) সকল স্তরের শিক্ষকবৃন্দকেই যে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এটার গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট সকলকেই উপলব্দিতে আনতে হবে। ঙ) দেশের ও আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজনের সাথে সংগতিপূর্ণ শিক্ষা যেন দেশের জনগোষ্ঠী গ্রহন করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। চ) শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার জন্য সরকার, শিক্ষক ও সমাজের আরও সম্পৃক্ততার ব্যবস্থা করতে হবে। ছ) শিক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটে আরও বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে একে দেশের সমৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ করনীয় হিসেবে গন্য করতে হবে। জ) শিক্ষার জন্য গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমকে সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে।