সাবরিনা শুভ্রা | ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ
বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ্য করে বললে, বলতে হবে- বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণার বোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি- যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। এখন যা আছে তা হল, ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচে’ বেশি আপন, যাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে আমাদের মানুষ করেছেন নিজের সব দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে আমার হাসি মাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যকুল থাকতেন, আমি না খেলে যিনি খেতেন না, আমি না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে থাকতেন আমার শিয়রে, যে বাবা-মা তিলে তিলে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন আমাকে মানুষ করার জন্য, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রমগুলো। মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে ছোট্ট শিশু থেকে মা-বাবা’র আদর-যত্ন ভালোবাসায় বেড়ে উঠি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী অবস্থান গড়ি। কেউবা রাষ্ট্রের অধিকর্তা, মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদ আবার কেউবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশায় আত্মনিয়োগ করি। এসব কিছুর পেছনে প্রেরণার উৎস হলেন আমাদের মা-বাবা। অথচ বৃদ্ধ বয়সে প্রতিষ্ঠিত অনেক সন্তানের মা-বাবাকে থাকতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে! বঞ্চিত হতে হয় পরিবার-প্রিয়জনদের সান্নিধ্য থেকে!
ছোটবেলায় যখন আমি অবুঝ, অসহায় শিশু- তখন একটু চোখের আড়াল হলেও দুশ্চিন্তায় কাতর হতেন মা-বাবা। নিজের সুখ, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে তিল তিল করে আমাদের বড় করে তোলেন তারা। অথচ সেই মা-বাবাকেই পরিবারে ঝামেলা ও বোঝা মনে করেন অনেক সন্তান। পাঠিয়ে দেন বৃদ্ধাশ্রমে অথবা মা-বাবাকে বাড়িতে একলা ফেলে সুখী-সমৃদ্ধ জীবন গড়ার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে বাবা বা মা বেঁচে নেই, একলা যিনি বেঁচে আছেন তার প্রতিও মমত্ববোধ জাগে না নির্বোধ ওই সন্তানের। কী বিস্ময়কর জন্মদাতা বাবা-মায়ের প্রতি তাদের প্রেমবোধ… কেন এ মানবিক বিপর্যয়?
অনেক ক্ষেত্রে সমাজের বাস্তব চিত্র হলো- অনেক সংসারে ছেলেরা বিয়ে করার পর পরই মা-বাবার সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে মা-বাবা’র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাতে সেই সন্তান। আর মেয়ে সন্তানেরা তো বিয়ের পর চলে যায় স্বামীর সংসারে। নিজের ঘর আর মা-বাবাকে অশ্র“জলে ভাসিয়ে স্বামী সংসারে নানা মানসিকতার মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে চলা- যেন অন্যরকম এক জীবনযুদ্ধে সামিল হতে হয়। মন চাইলেও নিজের মা-বাবাকে কাছে রাখার বা দেখভাল করার অথবা সমস্যায় থাকলে পাশে দাঁড়াবার সুযোগ হয় না এখনো অনেক মেয়েরই। সংসার টিকিয়ে রাখতে মা-বাবাকে দূরে রাখতে বাধ্য হয় অনেকে। সমাজ সংসারের নিষ্ঠুর এ বাস্তবতার পরিবর্তন দরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে মা-বাবাকে মনে পাথর বেঁধে বেছে নিতে হয় অসহায়-একাকীত্বের জীবন। অনেকে মা-বাবার ভরণ-পোষণ দূরে থাক খোঁজ-খবরও নেন না। আবার কেউবা দায়বোধ এড়াতে সামান্য কিছু খরচের টাকা দিয়ে মনে করেন দায়িত্ব পালন করলেন। কিন্তু বয়স্ক মা-বাবাকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কি আসলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়…না দায়বোধ এড়ানো যায়?
সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে- মা-বাবা’র প্রতি দায়িত্ব বোধ সমান। তাদের ভালোবাসার ঋণ চিরন্তন, যা কখনো শোধ হবার নয়। পবিত্র আল-কোরআনসহ পৃথিবীর সব ধর্ম গ্রন্থে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাদের প্রতি অসদাচারণ ও অবাধ্যতাকে গুনাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। তাইতো প্রায়ই খবর পাওয়া যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া মা-বাবার প্রতি অসম্মান, অবহেলা ও নিষ্ঠুরতার নানা অমানবিক ঘটনার। অনেক ক্ষেত্রে অধিকার আদায়ে বৃদ্ধ বয়সে আইনের আশ্রয় নেন অনেক অসহায় বাবা-মা।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে, গত ২০১৬ সালে সন্তানের ওপর তার বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ বাধ্যতামূলক করে একটি বিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। ওই বিলে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ না করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের জেলের বিধান রাখা হয়েছে। বিল অনুযায়ী, বাবা-মা আলাদা বসবাস করলে তাদের সন্তানের আয়ের ১০ শতাংশ নিয়মিতভাবে দিতে হবে। আইনে এ ধরনের অপরাধকে বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য, তবে আপসযোগ্য। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববান করতে সংসদে আইন পাস করতে হয়েছে- এটা খুবই দুঃখজনক।
এমন আইন শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম সরকার বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে অভিনব একটি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে- সরকারি কর্মচারীরা বাবা-মায়ের ঠিকমতো দেখভাল না করলে তাদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে নেয়া হবে এবং সেই অর্থ তার বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণেই ব্যয় করা হবে। নতুন এ আইন ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকেই বাস্তবায়ন শুরু হবে জানিয়েছেন আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
সম্প্রতি ভারতের আসামসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও ছেলে মেয়েরা বৃদ্ধ-অসুস্থ মা-বাবার ভরণ-পোষণ এবং যত্ন না নেয়ার ঘটনা ঘটছিলো। এর ধরনের অনেক ঘটনার অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে আদালতের রায়ে অধিকার ফিরেও পেয়েছেন অনেক মা-বাবা।
পারিবারিক ও সামাজিক এ ধরনের সমস্যা প্রতিকারে আসাম সরকারের এ পন্থাকে সাধুবাদ জানাই। কারণ ঘুণে ধরা এ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় কঠোরতার বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি আইনের বাস্তবায়নে প্রয়োজন যথার্থ প্রয়োগ।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
shuvraa7@gmail.com