অনলাইন ডেস্ক | ২৮ আগস্ট ২০১৭ | ১২:১৯ অপরাহ্ণ
নানা ধরনের জন্মগত ত্রুটি রয়েছে আরাফাতের। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর জন্মগতভাবে মেলিনগোমাইলোসিসে আক্রান্ত শিশু আরাফাতকে নিউরো সার্জারি বিভাগে ফেলে চলে যান অভিভাবকেরা। তখন তার বয়স ছিল ১৫ দিন। কক্সবাজারের রুমা আক্তার তাঁর খালাতো বোনের অসুস্থ মেয়েকে দেখাশোনার জন্য একই বিভাগের পাশের একটি শয্যায় ছিলেন। দুই-তিন দিনের মধ্যেই তিনি অভিভাবকহীন ওই শিশুটির মায়ায় পড়ে যান। সে মায়ার বন্ধন এমনই গত ডিসেম্বরে বোনের মেয়েটি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পরও রুমা বাড়ি ফেরেননি। বোনসহ অন্য স্বজনেরা পাঁচ মাসের ভাগনির লাশ নিয়ে ফিরে যান। কিন্তু রুমা ওই শিশুর জন্য হাসপাতালেই থেকে যান।
এক বছর ধরে হাসপাতালই যেন ঘরবাড়ি হয়ে গেছে কক্সবাজারের তরুণী রুমা আক্তারের (২২)। ফেলে যাওয়া অসুস্থ এক শিশুর মায়ায় হাসপাতালে পড়ে আছেন তিনি। নিজের আত্মীয় না হলেও ফেলে যাওয়া এই শিশুকে মায়ের মমতায় বড় করে তুলছেন তিনি। এক বছর ধরে আরাফাত নামের ওই শিশুটিই রুমার সব সত্তা দখল করে নিয়েছে। আরাফাত তাঁকে ছাড়া অন্য কারও কাছে যাবে এটা কল্পনাও করতে পারতেন না।
তবে সত্যি সত্যি আরাফাত ও রুমার বিচ্ছেদের দিন ঘনিয়ে আসছে। এক বছরের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা আরাফাতকে চট্টগ্রাম নগরের রৌফাবাদের ছোটমণি নিবাসে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আরাফাতকে নিয়ে যাওয়া হবে সহায়সম্বলহীন শিশুদের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বোঝা মনে করে হাসপাতালের নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অসুস্থ শিশুটিকে ফেলে গিয়েছিল অভিভাবকেরা। শিশুটিকে হারানোর আশঙ্কায় এখন দিন-রাত কাঁদছেন রুমা আক্তার।
সুস্থ হয়ে ওঠায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি শিশুটিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ আগস্ট সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ছোটমণি নিবাস থেকে হাসপাতালের পরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক নূরুন নাহার জান্নাতী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, আসন শূন্য থাকায় শিশু আরাফাতকে ছোটমণি নিবাসে ভর্তি করা যেতে পারে।
রুমার কাছে না দিয়ে আরাফাতকে ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, এটাই আইন। রুমা প্রায় এক বছর মায়ের মমতায় ছেলেটিকে বড় করেছেন। কিন্তু রুমা এখনো অবিবাহিত। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আরাফাতকে তাঁকে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু রুমাকে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
গতকাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিউরো সার্জারি বিভাগের ৩৩ নম্বর শয্যায় আরাফাতকে ভাত খাওয়াচ্ছেন রুমা। শয্যাজুড়ে অনেক খেলনা ছড়িয়ে আছে। ওসব নিয়ে খেলতে খেলতে এক বছরের আরাফাত মাঝেমধ্যে রুমাকে ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে ডাকছে।
জানতে চাইলে রুমা আক্তার বলেন, ‘ডাক্তারেরা বলেছেন আরাফাতকে নিয়ে যাবে। আমি বলেছি যদি আমাকেসহ নিয়ে যায় তাহলে আরাফাতকে ওখানে (বেবি হোম) নিতে দেব। আরাফাতকে ছেড়ে আমি কীভাবে থাকব! আমি তো ওকে ছাড়া বাঁচব না।’
চিকিৎসকেরা জানান, আরাফাত জন্মগতভাবে মেলিনগোমাইলোসিসে আক্রান্ত। সে দুই পা স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারত না। এ ছাড়া মস্তিষ্কে পানি ছিল। হার্নিয়ার সমস্যাও ছিল তার। তিনটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আরাফাত এখন ওই সমস্যামুক্ত।
অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, শিশুটি এখন সুস্থ। সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে। আপাতত তার কোনো সমস্যা নেই।
রুমার বাড়ি কক্সবাজারের বাহারছড়া এলাকায়। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে রুমা সবার ছোট। আরাফাতের মায়ায় গত এক বছর টানা হাসপাতালে থাকার পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আরাফাতসহ বাড়ি যান রুমা। পাঁচ দিন পর আবার হাসপাতালে ফিরে আসেন।
হাসপাতালের অজ্ঞাত রোগীদের সাহায্যে এগিয়ে আসা সাইফুল ইসলাম আরাফাতের জন্য খেলনা খাবার অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে আসেন মাঝেমধ্যে। সাইফুল বলেন, রুমা এখন আরাফাত ছাড়া কিছুই বোঝেন না। শিশুটিকে যদি বেবি হোমে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে রুমা খুব কষ্ট পাবেন।
হাসপাতালের সমাজসেবা কার্যালয়ের সমাজসেবা কর্মকর্তা অভিজিৎ সাহা বলেন, ‘আইনের কাছে আমরা বাঁধা। অভিভাবকহীন বাচ্চাদের বেবি হোমে পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। ঈদের পর আমরা আরাফাতকে বেবি হোমে পাঠাব।’