অনলাইন ডেস্ক | ০৭ জুলাই ২০১৭ | ১১:২০ পূর্বাহ্ণ
‘আব্বার ইচ্ছা ছিল তার সন্তানদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টার হবে। কিন্তু আমার বিধবা মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি তার কোনো সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ানোর। আমার মনে হয়েছিল আমি আইন পড়লে আমার আব্বার ইচ্ছা খানিকটা পূরণ হবে। আমি ল’ কলেজে ভর্তি হলাম আম্মার উৎসাহে। মফস্বল শহরের ল’ কলেজ। রাতে ক্লাস হয়, ক্লাস শেষ করে রাত ৯টার বেশি হয়ে যায়। ওই সময় মফস্বল শহরে অল্প বয়সের কোনো অবিবাহিত মেয়ে রাত ৯টায় রিকশায় করে বাড়ি ফিরবে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আমার মায়ের সাহস ও প্রেরণায় আমি আইন পড়া চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।’
কথাগুলো দেশের প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার। বাবার আশা (ব্যারিস্টার হওয়া) পূরণ না হলেও দেশের প্রথম নারী বিচারপতি হয়ে ইতিহাসে লিখিয়েছেন তার নাম।
বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চের এই নারী বিচারপতিকে বিদায় সংবর্ধনা দেন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন। অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের পাঁচ শতাধিক সিনিয়র ও জুনিয়র আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের পক্ষ থেকে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সভাপতি জয়নুল আবেদীন এ নারী বিচারপতির বর্ণাঢ্য কর্মময়জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন।
সবার বক্তব্য শেষে বিদায়ী কথা বলেন নাজমুন আরা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমার মনের জজ হওয়ার ইচ্ছাটা হয়তো জগৎকর্তাকে ছুয়েছিল। আমি ওকালতি করার বছর দেড়েকের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার নারীদের বিচারক না হওয়ার বিধান তুলে নেয়। ১৯৭৪ সালে সরকার বিচারক (মুন্সেফ) পদে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে কাগজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল। ওই বিজ্ঞপ্তির শেষ অংশে একটা লাইন ছিল, নারীরাও মুন্সেফ পদে আবেদন করতে পারবে। আমি আবেদন করলাম। ইতোমধ্যে আমার বিয়ে হয়ে যায়।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমি স্বামীর কর্মস্থল খুলনায় চলে যাই। খুলনা যাওয়ার ১৪ দিন পরেই খবর যায় আমার মা খুব অসুস্থ। খবর পেয়ে ময়মনসিংহে চলে আসি। ময়মনসিংহ আসার কয়েকদিন পর আম্মা একটু সুস্থ হলে বাসার লেটার বক্স খুলে আমার এডমিট কার্ড পাই। যদিও তা বেশ কয়েকদিন আগে এসেছিল, আম্মার অসুস্থতার জন্য লেটার বক্স চেক করা হয়নি বেশ কয়েকদিন।’
‘এরপর এডমিট কার্ড খুলে দেখলাম মাত্র ছয় থেকে সাতদিন পর আমার পরীক্ষা। ভয় পেলাম এত অল্প সময়ে প্রিপারেশন নিয়ে কী পরীক্ষা দেয়া সম্ভব। আমার মা আমাকে সাহস জোগালেন। এক কাজিনের বাসায় থেকে পরীক্ষা দেই, ভালোই হয় পরীক্ষা। যথাসময়ে ভাইভা পরীক্ষাও দেই। রিজাল্ট হয়। আমি নিয়োগ পাই।’
দেশের প্রথম এই নারী বিচারপতি বলেন, ‘রেজাল্ট আমার ভালোই হয়। ওই ব্যাচে আমরা ১৮ জন নিয়োগ পেয়েছিলাম। আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। আমার ওপরে দুইজনের একজন চাকরিতে যোগদান করেননি এবং অন্যজন চাকরি ছেড়ে দেন।’
তিনি বলেন, ‘আমার আম্মা যদি অসুস্থ না হয়ে পড়তেন, ওই বিশেষ সময়টায়, বিয়ের মাত্র ১৫ থেকে ২০ দিন পর, খুলনা থেকে আমার ময়মনসিংহে আসা হতো না, পরীক্ষা হয়তো দেয়া হতো না, বিচারক হওয়াও হতো না। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমাকে বিচারক করবেন বলেই হয়তো আমার আম্মা ওই সময়টাই অসুস্থ হয়েছিলেন।’
বিচারপতি নাজমুন আরা বলেন, ‘আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচারাঙ্গণ থেকে বিদায় নিচ্ছি। সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনই জেনে-বুঝে বা অবহেলায় বা অমনোযোগী হয়ে কোনো ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি। আমার অনেক বিচারই হয়তো ভুল হয়ে গেছে, আপিলে গিয়ে হয়তো সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু সে ভুল বিচার আমি জেনে-বুঝে বা অমনোযোগী হয়ে করিনি।’
তিনি আরও বলেন, জেনে-বুঝে অবিচার করা বা অমনোযোগী হয়ে বা অবহেলা করে ভুল বিচার করা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। পক্ষাশ্রিত হয়ে বা কোনো কারণে বা কারও দ্বারা প্রভাবান্নিত হয়ে বিচার করা মহাপাপ। আমার আত্মতৃপ্তি আমি জেনে-বুঝে বা অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে বা পক্ষাশ্রিত বা প্রভাবান্নিত হয়ে ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার কখনোই করিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার সমস্ত জ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে সবটুকু মনোযোগ দিয়ে, সমগ্র একাগ্রতা দিয়ে বিচার কাজ করে গেছি আমার এই সুদীর্ঘ বিচারিক জীবনে। আমি বিশ্বাস করি আল্লার পরেই ন্যায় বিচারের স্থান। যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে।’