ডক্টর শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | ১০:২৯ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটছে স্রোতের মতো। আগে থেকেই পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে বাংলাদেশে।
নতুনভাবে আরও তিন লাখ শরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশকে ভয়াবহ মানবিক সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চড়াও হওয়ার ঘটনায় দলে দলে নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জাতিগত নিপীড়ন সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্রে সরকারি মদদে বৌদ্ধভিক্ষু এবং রাখাইনদের উসকে দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম বিদ্বেষকে তারা এ ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। জাতিগত এ নিপীড়নে শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু রোহিঙ্গারাও বর্বরতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যও রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সে দেশের শাসন ক্ষমতায় নিজেদের অপপ্রভাব বজায় রাখতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাতিগত বিভাজন টিকিয়ে রাখছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মিদের শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে তারা শুধু রোহিঙ্গা না, কারেন, শানসহ প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। সে দেশের প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ায় এবং তাদের প্রত্যাবর্তনে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী এবং তাদের সঙ্গে আপসকারী নির্বাচিত সরকারের কোনো আগ্রহ না থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হতে হবে।
সভ্য দুনিয়ায় কোনো দেশ তাদের নাগরিকদের ওপর কথায় কথায় চড়াও হবে তা মেনে নেওয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক নিপীড়নমূলক অভিযানের পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের হামলাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করা হচ্ছে। তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা না থাকায় এ অভিযোগ কতটা সত্যি তা প্রমাণ করা কঠিন। অভিযোগটি সত্যি হলেও সে অজুহাতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হওয়া কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জেগে উঠবে এমনটিই প্রত্যাশিত।
এ কথা বলতেই হয়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যে কোনো ছুঁতোয় দেশটির রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করে না। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর এমন নৃশংস ও অমানবিক হত্যা এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেও মিয়ানমার সরকার তা থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। দেশটির সরকারের আচরণে এটাই প্রতীয়মান হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা দূরে থাক মানুষ বলেই মনে করে না সরকার। তার সর্বশেষ জনসংখ্যা জরিপে রোহিঙ্গাদের মূল নাগরিকের বাইরে ‘আদারস’ বা ‘অন্যান্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা উদ্বাস্তু ও ভাসমান। অবশ্য দেশটির সরকার সবসময়ই মনে করে আসছে, রোহিঙ্গারা নাকি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা বাঙ্গালি। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যুগের পর যুগ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উৎসাদনে অভিযান চালিয়ে আসছে। এতে নিজেদের ভিটেমাটি ও সহায়-সম্বল ফেলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার তাদের কক্সবাজারসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ভরণ-পোষণেরও দায়িত্ব নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বহুবার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হলেও মিয়ানমারের আচরণে অনেকটা উদাসীনতা ও অনীহা ফুটে উঠেছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা। তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দুঃখের বিষয়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অস্বীকার করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে। এর সাথে যুক্ত হয় উগ্রবাদী বৌদ্ধ গোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী স্টিম রোলার চালাতে থাকে এবং এখনও চালাচ্ছে। এই নিপীড়ন, বিতাড়ন ও হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার সরকার।
এমনকি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করা অং সান সুচিও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। ক্ষমতায় আসার পর সমালোচনার মুখে পড়ে কয়েক মাস আগে মুখ রক্ষার্থে অনেকটা দায়সারাভাবে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দেন তিনি। তাতেও রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ হয়নি। এখন আবার ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ তকমা লাগিয়ে হত্যাযজ্ঞকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পরবাসী করার বা অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেয়ার বিষয়টিকে বৈধতা দেয়ার পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গাদের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে এটাই পরিদৃষ্ট হয়, পৃথিবীতে বসবাস করার জন্য তাদের পায়ের নিচে কোনো মাটি নেই। তারা ভাসমান। বিশ্বে এমন জাতিগোষ্ঠী আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নাই। মানবতার এমন বিপর্যয় এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া ভার।
রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়িতে যে হামলা ও পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তা নিন্দনীয়। তবে এ হামলায় কে বা কারা জড়িত তা এখনও স্পষ্ট নয়। কোনো গোষ্ঠীও এখন পর্যন্ত হামলার দায় স্বীকার করেনি। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী যেভাবে রাখাইন রাজ্যে অভিযান চালিয়ে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা কোনো যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সঠিক তদন্ত ও হামলাকারীদের শনাক্তকরণ ছাড়া তারা যেভাবে রোহিঙ্গাদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে রোহিঙ্গা নিধনের উসিলা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বলা হচ্ছে, অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিনা অপরাধে বা যে কোনো ছুঁতোয় যদি কারও উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হয়, তবে জীবন বাঁচাতে আক্রান্তদেরও প্রতিরোধ করার অধিকার রয়েছে। আমরা মনে করি, পুলিশ ফাঁড়িতে কারা কী কারণে হামলা চালিয়েছে, আগে তার যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন। তা না করে এর দায় পুরো রোহিঙ্গা জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া মোটেই সঙ্গত ও উচিত নয়। আমরা আশা করব, মিয়ানমার সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান বন্ধ করবে, এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে আহ্বান জানিয়েছে, তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে।
লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম এবং প্রধান সম্পাদক দৈনিক আজকের অগ্রবাণী।
e-mail: advahmed@outlook.com