| ২১ জানুয়ারি ২০২১ | ১১:০১ অপরাহ্ণ
শিখা মনি। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার পাটপঁচা এলাকার ইপসা গেটের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। স্বামী দুবাইয়ে প্রবাসী এবং নিঃসন্তান হওয়ায় এখানে একাই থাকতেন শিখা। ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর বিকেল সাড়ে চাটার দিকে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হন তিনি।
শিখার বাড়ির মালিক মোস্তফা বলেন, ‘আগে শিখা ছিল মতি চাচার বাসায়। পরে আমি ওখান থেকে শিখার মায়ের মোবাইল নাম্বার জোগাড় করে আমি তার মাকে ফোন দিয়ে জানাই যে মেয়েটা কোথায় গেছে। তখন মেয়েটার মা বলে পাশের বাসার কয়েকজনের সাথে শিখার ভালো সম্পর্ক আছে আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তখন আমি তাদের কাছে গেলে তারা বলে, মেয়েটা ঢাকা গেছে।’
শিখা নিরুদ্দেশ হওয়ার ২১ দিন পর তাঁর মা সুফিয়া বেগম গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ জিএমপির সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডিতে শিখার নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্য কাউকে সন্দেহ করেননি তিনি। সাধারণ ডায়েরিতে শিখার শারীরিক বর্ণনা দেন এরকম: বয়স আনুমানিক ২২ বছর। গায়ের রং শ্যামলা। উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। নিরুদ্দেশ হওয়ার সময় পরনে ছিল শালোয়ার-কামিজ।
শিখার পরিবারের কাছে প্রশ্ন ছিল, থানা পুলিশকে জানাতে এত দেরি করলেন কেন তারা ? এতদিন লাপাত্তা থাকার পরও কাউকে সন্দেহ হলো না কেন তাদের?
শিখার মা সুফিয়া বেগম বলেন, তাদের বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী আসছে যাচ্ছে। স্বামী এখানে শিখাকে দিয়ে গেছে তখন ভালো ছিল। এর মধ্যে শিখাকে বাসায় রেখে স্বামী ২/৩ বার বিদেশে গেছে।
শিখার বোন আনজুম বলেন, আমার বোন এমনিও এক সপ্তাহ পর পর ফোন দিত। তো আমার মায়ের অসুখ হলে আমরা তাকে ফোন দেয়। তখন সে বলে দেখি আমার হাতে টাকা পয়সা নেই।
এদিকে শিখা নিখোঁজ হওয়ার ১৬ দিন পর ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর পোড়াবাড়ি পূর্বপাড়া, কোনাপাড়া এলাকার জাকির হোসেনের পুকুরের উত্তর পূর্ব কোণে কাদার মধ্যে মাথা খানিকটা বের করা অবস্থায় একটি মৃতদেহের সন্ধান পান স্থানীয়রা। তাদের ধারনা জঙ্গলের শেয়াল টেনে বের না করলে নির্জন এই জায়গায় কাউকে পুঁতে রাখার খবর কোনোদিন জানাই যেত না।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমি একদিন দেখি এখানে পাখি কুকুর বসে আছে। পরে আমি গরু রেখে এখানে আস্তে আস্তে এসে দেখি চুল পড়ে আছে। তারপর আমি এখানে থেকে চলে যায়।
গাজীপুর সদর থানা পুলিশ এসে মাটি খুঁড়ে মরদেহটি উদ্ধার করে। সুরতহালে রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেন নারী কন্সটেবল রুমা আক্তার। সুরতহাল রিপোর্টে মরদেহটি আনুমানিক ৩২ বছর বয়সী একজন নারীর বলে উল্লেখ করা হয়। স্থানীয়রা অনেকেই দেখলেও মৃতদেহটি কার তা সনাক্ত করতে পারেনি কেউ। কেননা মরদেহের পরনে কোনো কাপড় ছিল না। এমনকিপুরো শরীর ছিল চামড়াবিহীন এবং ফোলা।
ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ। সাথে সাথে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়। অজ্ঞাতনামা মহিলাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে জানান চিকিৎসক। পেনাল কোডের ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় নিয়মিত মামলা করেন গাজীপুর সদর থানার এসআই মোহাম্মদ মাহাবুব।
সদর থানার এসআই জহির মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান। যে এলাকায় মরদেহ পাওয়া গেছে সে এলাকা থেকে আলমগীর নামের এক যুবকে গ্রেফতার করেন তিনি। আলমগীর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।
তাতে তিনি জানান, পুকুর পাড় থেকে উদ্ধার করা মরদেহটি তার চাচা মোকসেদের বান্ধবীর। খুনের বিষয় ও মরদেহের পরিচয় তিনি জানেন না। লাশ গুমে চাচাকে সহায়তা করেছেন মাত্র।
নিয়ম অনুযায়ী আলমগীরের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির পর নিজের থাানাসহ অন্যান্য থানায় হওয়া নিখোঁজের জিডি ধরে অনুসন্ধান করার কথা ছিল এসআই জহিরের। কথা ছিল মামলার ভিক্টিম অজ্ঞাতনামা মরদেহের ডিএনএ প্রফাইলিং নিশ্চিত করা। ধরার চেষ্টা করা আলমগীরের চাচা মোকসেদকে। প্রশ্ন হল সে চেষ্টা কি তিনি করেছেন?
২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দুই বছর মামলাটির তদন্ত করেন এসআই জহির। এরমধ্যে তিনি কেন, কাকে, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারেননি। ধরতে পারেননি আলমগীরের চাচা মোকসেদকেও। এ অবস্থায় মামলা তদন্তের দায়িত্ব আসে গাজীপুর জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইয়ের কাছে।
পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর শাকিল হাসান বলেন, মামলাটা যখন পুলিশ হেডকোয়ার্টার এর মাধ্যমে আমাদের কাছে আসে। তখন আমরা জানি যে এই ঘটনাটা মোকসেদ নামের একটা লোক ঘটাইতে পারে। এর আগে পুলিশ দুইজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেখানে ভিকটিমের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। আমাদের তদন্তের পুরো বিষয় ছিল ভিকটিমের পরিচয় উদঘাটন করা। পাশাপাশি এ ঘটনার মূল আসামিকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা।
দায়িত্ব পাওয়ার দিনের মাথায় গোয়েন্দা তৎপরতার এক পর্যায়ে পিবিআই জানতে পারে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থান করছেন মোকসেদ। এও জানতে পারে, মোকসেদ তার বড় ভাই ও ভাতিজা গ্রেফতার হওয়ায়, আইনজীবী ধরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ারও চেষ্টা করছে । এমনকি ৫ লাখ টাকা চুক্তির ৫০ হাজার টাকাও আইনজীবীকে দেওয়া হয়েছে।
শাকিল হাসান আরও বলেন, যেহেতু মোকসেদ ছাড়া আর কোনো অপশন নেই এবং সেই মূল পরিকল্পনাকারী। তাই তাকে গ্রেফতার না করলে এই মামলার জট খুলত না। আর সে কারণে আমাদের উপরের অফিসাররা জোর দেয় মোকসেদকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে। আবার আমরা তদন্তে জানতে পারি যে মোকসেদ উচ্চ আদালতে গিয়ে এই মামলা থেকে জামিনের জন্য দৌঁড় ঝাপ করতেছে।
মোকসেদের আদালতে যাওয়ার আগের দিন তাকে ধরতে অভিযানে নামে পিবিআই। মোকসেদের কাছে পৌঁছাতে প্রথমে তার এক পরিচিত ব্যক্তিকে আটকের সিদ্ধান্ত নেয় পিবিআই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলে তার সন্ধান।
ওই ব্যক্তির কাছ থেকে জানা যায়, তৃতীয় স্ত্রীর সাথে বাসন থানার শাহআলমবাড়ি এলাকায় এমদাদের বাড়িতে মামুন ছদ্মনামে থাকেন মোকসেদ। পিবিআইয়ের অভিযানে অজ্ঞাত নারীর মরদেহ উদ্ধারের ২ বছর পর গ্রেফতার হন মো: মোকসেদ আলী।
গ্রেফতারের পর মোকসেদ আলী জানান, অজ্ঞাতনামা ওই নারী কে এবং কেন ও কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মোকসেদ আলী জানান, তিনি গরুর দুধ বিক্রি করতেন। দুবাই প্রবাসী এক ব্যক্তির স্ত্রী শিখা মনির বাসায় দুধ বিক্রির সময় দু’জনের পরিচয় বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কে গড়ায়। তারা দুজনই একজন আরেক নের বাড়ি নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। এক পর্যায়ে, গরু কেনার জন্য টাকা চাইলে, শিখা মনি স্বামীর পাঠানো টাকা থেকে দেড় লাখ ধার দেন মোকসেদকে। শিখা ধার দেয়া টাকা ফেরত চাইলে, দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়।
যেখান থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে তার কাছেই হাজারি বাগান পেরিয়ে গজারি বন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে দেখা করার কথা বলে শিখাকে এই বনে নিয়ে আসে মোকসেদ। কথা বলার এক পর্যায়ে ওড়না পেচিয়ে শিখাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মোকসেদ।
এরপর রাত ১১টার দিকে ভাই মজিবর, ভাতিজা আলমগীর ও জাহাঙ্গীরকে ডেকে নিয়ে আসে। কোনোভাবেই যেন পরিচয় জানা না যায় তা নিশ্চিত করতে, শিখা মনির জামা কাপড় খুলে, তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় মাটি চাপা দেয় তারা।
অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলতে শিখার গা থেকে খুলে নেয়া কাপড় চোপড় নিজের বাড়িতে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন মোকসেদ। আর শিখার মোবাইল ফোনটি পাশের ডোবায় ফেলে দেন। ঘরে কোদাল রেখে গা ঢাকা দেন। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, মোকসেদ এরপরও শেয়াল লাশের অস্তিত্ব জানান দেয়ার আগ পর্যন্ত এলাকায় দিন পনের অবস্থান করেন ।
মোকসেদ জানায় শিখার গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ার আড়াল বাজার। পিবিআই তখনো জানে না যে, আড়াল বাজারের সুফিয়া বেগম তার মেয়ে শিখা মনি নিখোঁজ জানিয়ে থানায় জিডি করেছেন।
পরিবারকে শিখার মরদেহের ছবি দেখায় পিবিআই। জানায়, মোকসেদের দেয়া বিবরণও। তারপরও তারা মানতে নারাজ যে শিখা খুন হয়েছেন। কিন্তু কেন?
পরিবার যখন মানতে চাইছে না, তখন পিবিআই কিভাবে নিশ্চিত যে পুকুরের গর্ত থেকে তোলা নারীর মরদেহ আর আড়াল বাজারের সুফিয়া বেগমের শিখা মনি একই মানুষ?
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশে ভিক্টিমের মৃতদেহ থেকে ময়নাতদন্তের সময় সংরক্ষিত ডিএনএ নমুনা আলামত চুল ও দাঁত এবং আড়াল বাজারের সুফিয়া বেগমের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে পিবিআই।
ময়নাতদন্তের পরপরই সংরক্ষিত আলামত ডিএনএ প্রফাইলিং এর জন্য সিআইডিতে কেন পাঠানো হয়নি? এর সদুত্তর দিতে পারেনি শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
অপরাধ মাটি চাপা দেয়ার সব চেষ্টার পরও, বলা যায় অলৌকিকভাবেই জঙ্গলের শেয়ালের কারণে জানা গেছে মরদেহের অস্তিত্ব। তারপরও একই থানা গুম ও নিখোঁজের খোঁজ জানার পরও রহস্য উদঘাটনে তৈরি হওয়া এই জটিলতার জন্য কে বা কারা দায়ী তা বের করাও জরুরি।
যে দু বছরের বেশি সময় লাগলো তার জন্য কি নিছক উদাসিনতা দায়ি নাকি পেছনে আছে অন্য কোনো কারণ।
লাশ মাটি চাপা দিয়ে, মোকসেদ মরদেহ উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত ১৫ দিন এলাকাতেই ছিলেন। এরপর গা ঢাকা দেন মোকসেদ। প্রথমে ময়মনসিংহের একটি হোটেলে একমাস পালিয়ে থাকেন। তারপর ঢাকার পশ্চিম কমলাপুরে ছিলেন, ১০/১২ দিন, এলাকায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ||
৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ |
১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ |
২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ |
২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |