অগ্রবাণী ডেস্ক | ১০ জুন ২০১৭ | ৮:০৮ অপরাহ্ণ
বাংলা সিনেমার একসময়কার তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি তাঁকে খুন করা হয়েছিল—২০ বছরেও পুরোপুরি মীমাংসা হয়নি এ প্রশ্নের। চার দফা তদন্ত এ প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর দিতে পারেনি। অবশেষে আবার শুরু হয়েছে তদন্ত। এবার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে পুলিশের নবগঠিত একটি সংস্থাকে, যার নাম পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
নতুন তদন্তকারীরা নেমেছেন টুকরো টুকরো আলামত, ইশারা মিলিয়ে ২০ বছর আগের মৃত্যুমুহূর্তটি পুনর্নির্মাণের কাজে। তাঁরা স্বীকার করছেন, অত্যন্ত কঠিন হবে এ কাজ। কেননা গত ২০ বছরে অনেক আলামতই আর অবিকৃত নেই। অনেককেই আর সাক্ষ্যের জন্য পাওয়া যাবে না।
সিনেমার জগতে সালমান শাহ নামে পরিচিত হলেও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেতার পুরো নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, র্যাব একে একে মামলাটির তদন্ত করে। মাঝখানে ১৫ বছর ধরে চলেছে বিচার বিভাগীয় তদন্তও। সব কটি তদন্ত প্রতিবেদনেই এটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নায়কের লাশ ও অপমৃত্যু মামলা
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন গার্ডেন এলাকায় ভাড়া বাসায় পাওয়া যায় অভিনেতা সালমান শাহর লাশ। বাংলা সিনেমায় তাঁর জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। স্ত্রী সামিরা হক পুলিশকে জানান, সকালবেলা ড্রেসিংরুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমানের দেহ তাঁরা শনাক্ত করে দেহটি নামিয়ে আনেন।
সালমান শাহকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। সালমানের বাবা কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী রমনা থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন। ২০০২ সালে মারা যান সালমান শাহর বাবা।
অপমৃত্যুর ওই মামলায় বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে গ্রীনরোডের নিজ বাসা থেকে ইস্কাটনে সালমানের ভাড়া বাসায় ছেলের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কমর উদ্দিন। সালমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল ও তাঁর স্ত্রী সামিরা তাঁদের বলেন, ‘সালমান রাত জেগে কাজ করেছে। এখন তাঁকে ঘুম থেকে ডাকা যাবে না।’ তিনি প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসায় ফিরে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেলিম নামের একজন ফোন করে জানান, সালমানের কী যেন হয়েছে। সালমানের বাবা, মা ও ভাই ওই ফ্ল্যাটে ছুটে যান। গিয়ে শয়নকক্ষে সালমানের নিথর দেহ দেখতে পান তাঁরা।
সালমানের মা নীলা চৌধুরী বলেন, সালমানের মৃত্যুর দিনই অনেকটা পরিবারের অজান্তে সালমানের বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরীর স্বাক্ষর নিয়ে রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে পুলিশ। সেই মামলার তদন্ত চলছিল। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে রিজভি আহমেদ নামের একজন অন্য এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, সালমান শাহকে হত্যা করে আত্মহত্যার ঘটনা সাজানো হয়েছে এবং তিনি (রিজভি) নিজেও সেই হত্যায় জড়িত ছিলেন। সালমানের বাবা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আদালতে নালিশি হত্যা মামলা করেন। আদালত দুটি অভিযোগ একসঙ্গে তদন্তের নির্দেশ দেন।
মৃত্যু আসলে কখন হয়েছে?
মা নীলা চৌধুরী বলেন, কমরউদ্দিন ঘটনার দিন সালমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও তাঁকে দেখা করতে না দেওয়া অত্যন্ত সন্দেহজনক।
এ নিয়ে কথা হয় পরিচালক বাদল খন্দকারের সঙ্গে, যিনি ওই দিন সালমানের বাসায় গিয়েছিলেন। বাদল খন্দকার বলেন, ছবির কাজের শিডিউল নিতে তিনি সকালে সেখানে গেলে বাসার নিচে দারোয়ানেরা তখন বলাবলি করছিল, সালমান রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা গেছেন। এরপর সালমানের বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, ড্রেসিংরুমে সালমানের মরদেহ পড়ে আছে। সালমানের বাবা-মাকে এ খবর দেওয়া হয়নি জানতে পেরে তিনি সেলিম নামের চলচ্চিত্রের একজন প্রডাকশন ম্যানেজারকে সালমানের বাসায় খবর দিতে বলেন।
কথা হয় সালমানের তখনকার সহকারী আবুল হোসেন খানের সঙ্গে। ঢাকার অদূরে নবাবগঞ্জে থাকেন আবুল। তিনি বলেন, ওই দিন শুক্রবার বেলা ১১টায় ঘুম থেকে উঠে পানি ও চা পান করে ড্রেসিংরুমে ঢোকেন সালমান। পরে সালমান জুমার নামাজ পড়তে যাবেন কি না তা জানার জন্য ওই রুমের দরজায় টোকা দিয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পারেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পরে সালমানের স্ত্রী সামিরা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখতে পান, সালমানের দেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। রশি কেটে তাঁর দেহ নামানো হয়।
সালমানের বাসার লিফটম্যান আবদুস সালামের সঙ্গেও ওই বাসার নিচে কথা হয়। সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইস্কাটন প্লাজার এই বাসায় ২৯ বছর ধরে কাজ করছি। ঘটনার দিন সকালে শুনতে পারি, সালমান ভাই আত্মহত্যা করেছেন। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’
সুইসাইড নোটের লেখক কে?
সালমানের বাসা থেকে পুলিশ একটি সুইসাইড নোট বা আত্মহত্যার চিঠি উদ্ধার করে।
চিঠিতে লেখা আছে, ‘আমি চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার, পিতা-কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ১৪৬/৫, গ্রীনরোড, ঢাকা-১২১৫ ওরফে সালমান শাহ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে আজ অথবা আজকের পরে যেকোনো দিন মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’
এই চিঠিতে কারও স্বাক্ষর ছিল না। তবে সিআইডির হস্তবিশারদেরা পরীক্ষা করে বলেছেন, এটা সালমান শাহের হাতের লেখা।
কিন্তু সালমানের মা নীলা চৌধুরী এই চিঠি নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ওকে ইমন নামেই ডাকতাম। অথচ চিঠিতে ইমন নামের কোনো অস্তিত্ব নেই। ও থাকে ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু ঠিকানা লেখা আছে আমাদের বাসার। সালমান শাহ নামটিও ঠিকানার পরে লেখা।’
চিঠির ভাষার আনুষ্ঠানিক ভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলে নীলা চৌধুরী আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করার আগে এ রকম মামলা লেখার স্টাইলে এত গুছিয়ে বাবার নাম, ঠিকানা উল্লেখ করে চিঠি লেখে বলে আমার জানা নেই। এখানেই আমার ঘোরতর সন্দেহ।’ সূত্র : প্রথমআলো