| ২৫ মার্চ ২০২০ | ১০:০০ পূর্বাহ্ণ
দুই বছরে অনেক দেন-দরবার আর সমঝোতা। পাশাপাশি বিএনপির মিটমিটে আন্দোলন। এসবের কোনো কিছুই যেন পর্যাপ্ত ছিল না কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য। সবশেষ পরিবারের উদ্যোগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুক্তির মানবিক আর্তি। যার কল্যাণে দুই বছরেরও বেশি সময় পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৭৭৪ দিন কারাবন্দির অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই নিজ বাসভবন ফিরোজায় ফিরছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
দিনটি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ জারি করেন আদালত। প্রথমে পাঁচ বছরের কারাদন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে যান ৭৫ বছর বয়সি খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসভবন থেকে স্থান হয় পুরান ঢাকার নাজিম রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। তবে জেলখানায় অসুস্থ হয়ে পড়লে দুই দফায় আনা হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। সবশেষ গত বছরের ১ এপ্রিল ভর্তি করা হয় বিএসএমএমইউতে। এতদিন হাসপাতালের কেবিন বøকের ৬১২ নম্বর রুমে মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
সব ঠিক থাকলে আজ বুধবার টানা ২ বছর ১ মাস ১৫ দিন পর গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাড়ি ফিরোজায় যাবেন খালেদা জিয়া। হাসপাতাল থেকে সরাসরি সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে তার। এ জন্য মঙ্গলবার রাতেই বাসভবন ফিরোজার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। খালেদা জিয়াকে বরণ করতে ফিরোজার ভেতরের কক্ষগুলো প্রস্তুত করা হয়।
এদিকে দলীয় প্রধানকে কারাগারে রেখে রোজ গণমাধ্যমে হাহুতাশ আর সভা-সমাবেশে হইচই করা বিএনপি অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে খালেদা জিয়ার জামিনে। তবে বিদেশ যেতে বাধার শর্তে মুক্তিতে কিছুটা নাখোশ দলটির শীর্ষ নেতারা। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে দলের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের শান্ত ও সংযত থেকে ভিড় না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আর এ মুক্তির মূল নায়ক খালেদা জিয়ার মেজ বোন সেলিমা ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বোন সেলিমা ইসলাম। তিনিই সবসময় হাসপাতালে স্বজনদের নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তির খবরে পরিবার খুবই আনন্দিত। আর কারাগার থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান বোন সেলিমা ইসলাম।
খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের হাসপাতাল ও গুলশান কার্যালয়ে ভিড় না করার পরামর্শ দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, সারা দেশের মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দেশের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তির খবর। তবে নেতাকর্মীরা যাতে আবেগে আপ্লুত হয়ে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে ভিড় বা জনসমাগম না করেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তির খবরে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করে বিএনপি। যেখানে স্কাইপের মাধ্যমে যুক্ত হন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সঙ্গে ছিলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও। মুক্তির খবরে বিকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীরা বিএসএমএমইউতে ভিড় জমান।
মির্জা ফখরুল বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে যেটা আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, সে জন্য দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান থাকবে আপনারা সবাই শান্ত থাকবেন এবং যাতে কেউ আক্রান্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সারা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়েছিল। এর জন্য হলেও তারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন যে খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন এবং চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু তিনি যেহেতু বাইরে চিকিৎসা করতে পারবেন না, তাই এ বিষয়টা নিয়ে আমরা অনেকটা চিন্তিত। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমাদের ভালো করে দেখতে হবে। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির বিষয়টা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটা আমরা আলোচনা সাপেক্ষে জানতে পারব।
কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। দেশবাসীর কাছে তিনি খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, এই মহামারীর সময় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিষয়টি ইতিবাচক দেখেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের নেতা ও অন্যতম নেতা জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক। তাদের ধন্যবাদ জানাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল খালেদা জিয়ার মানবিক মুক্তির সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানায়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর তাকে রাখা হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মামলায় ওই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট তার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল ও জামিন আবেদন করা হয় গত বছর ১৪ মার্চ। তারপর ১০ মাসেও মামলায় আপিল ও জামিন শুনানির উদ্যোগ নিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবীরা। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। সর্বশেষ গত বছরের ১২ ডিসেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। খুব সম্প্রতি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। পরে খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়ার আবেদন করেন বেগম খালেদা জিয়ার ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্যরা। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।