
নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
১৭ সেপ্টেম্বর, আজ সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকেই। তাদের স্মরণে এই দিনকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
এ বছর দিবসটির এবার ৬ দশক বা ৬০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। দিনটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন আজ নানা কর্মসূচি পালন করছে।
স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরীফ কমিশন নামে খ্যাত এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল।
প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ঐ প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।
শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। পাঁচ বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তিন বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর।
এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।
ঐ দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়।
তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন বাবুল, গোলাম মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র। রাজপথ নরকে পরিণত হয়, কিন্তু পিছু হটতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন আর করতে পারেনি।
এরপর শুরু হয় গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন। আর ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিনটি প্রতিষ্ঠা পায় মহান শিক্ষা দিবস হিসেবে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে দিনটি কি সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে? সকল শিক্ষক কি দিবসটির কথা জানেন? শতকরা কতজন শিক্ষার্থী জানেন? ছাত্রসমাজের এই আত্মত্যাগ জাতি কি স্মরণ করবে না? দিনটি নিয়ে কি মিডিয়ায়ও খুব একটা আলোচনা হয়? আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না কেন?
শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়: প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। পাঁচ বছরে প্রাথমিক, পাঁচ বছরের মাধ্যমিক, তিন বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ ৭০ নম্বর।
এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মূলে কুঠারাঘাত করার শামিল। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিলো। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিলো।
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। বর্তমান শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক এ আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ‘অল পার্টি স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি’ ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়।
ওই দিন সকাল দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে এমন গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গণি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে।
পুলিশের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ বাধে ঢাকা কোর্টের সামনে। এখানেও পুলিশ-ইপিআর গুলি চালায়। এতে বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন, আহত হন শতাধিক এবং শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গিতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিককে।
সেই থেকেই ১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয়ে আসছে ছাত্রসমাজের শিক্ষার অধিকার আদায়ের লাড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যের দিবস ‘মহান শিক্ষা দিবস’। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে শিক্ষার সার্বজনীন অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা যেটি দেখতে পাই, মোট আহতের সংখ্যা ছিলো ২৫৩। ১০৫৯ ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীরা মৌন মিছিল বের করে। প্রতিবাদ দিবস পালনের মাধ্যমে ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে।
সেইদিন পল্টন ময়দানে ছাত্রদের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের উত্তপ্ত অবস্থায় ১৯৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লাহোরে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয় সোহরাওয়ার্দি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা মওদুদি, মাহমুদ আলী, জহিরুদ্দিনের উদ্যোগে। তারপর শুরু হয় ধারাবাহিক আন্দোলন যা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এসব ঘটনা ধীরে ধীরে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথের দিকে ধাবিত করে। তবে, একথা সত্যি যে, ৫৮-৫৯ বছর পার হলো, কিন্তু শিক্ষার সার্বজনীন যে আকাঙ্ক্ষা তা কিন্তু পূরণ হয়নি; যদিও আমরা এগিয়েছি অনেক।
মহান ভাষা আন্দোলনসহ সকল প্রকার আন্দোলনে আমাদের ছাত্রসমাজের যে গৌরবোজ্জল ভূমিকা, সেটিকে বেশি বেশি আলোচনায় আনা প্রয়োজন। কারণ বর্তমানে যে ছাত্ররাজনীতি চলছে তা ত্যাগের নয়, ভোগের। বর্তমানের ছাত্রসমাজকে জানতে হবে স্বাধীনতাপূর্বকালে ছাত্রসমাজের যে চরম আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মহান শিক্ষা দিবসের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জল আত্মত্যাগের কথা যেনো আমরা ভুলতেই বসেছি। এ নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই, নেই উচ্ছ্বাস। তারা যেজন্য আন্দোলনে করেছিলেন এবং পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে শিক্ষা সংকোচন নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই স্বপ্ন কি আজও বাস্তবায়িত হয়েছে?
শিক্ষার লক্ষ্য মনে হচ্ছে যেন একজন কেরানি ও প্রশাসক হওয়া, যেন এসব মানেই জীবনের সব পাট চুকে যাওযা। জ্ঞানের আলোচনা নেই, সৃজনশীলতা নেই, মানবতা নেই, সহমর্মিতা নেই, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানা না জানার বালাই নেই, দেশপ্রেম নেই। একজন উচ্চশ্রেণির কেরানি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে সব উচ্চশিক্ষিতরা। এ কেমন সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি যে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়াটাই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত? ‘একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৬২ সালের ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৭ সেপ্টেম্বর। সেই আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সঙ্গে সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে মেহনতী মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো ৯৫ শতাংশ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে এপার পর্যন্ত নৌকার মাঝিরা বৈঠা হাতে মিছিলে চলে এসেছেন।
চারটি বড় দাগের ঘটনা বা বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তত করেছে। সেগুলো মধ্যে একটি হচ্ছে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। ১৭ সেপ্টেম্বর এতো গুরুত্বপূর্ণ দিন হওয়া সত্ত্বেও দিনটি এখনও জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি পায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তন আসেনি, যদিও ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন ছিলো বাঙ্গালী জাতির মুক্তির লক্ষ্যে এক মাইলফলক। দূর হয়নি, বরং আরও বেড়েছে গ্রাম ও শহরের মাঝে শিক্ষাবৈষম্য। শিক্ষাদানের ব্যাপ্তি বেড়েছে কিন্তু মান কমেছে সর্বত্র। এই মানহীন শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটি আমাদের বাস্তব দৃষ্টিকোণ দিয়ে ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
Posted ৪:০৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin