
নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর ২০২২ | প্রিন্ট
কক্সবাজারে দিনদিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতায় চরম দুর্বিষহ দিন যাপন করছেন সীমান্ত পাড়ের মানুষ। শুধু তাই নয়, বন্ধ হয়েছে সীমান্ত বাণিজ্যও। এছাড়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতায় বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত পুরো কক্সবাজারের মানুষ। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের কারণে স্থানীয়রা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে ২৪ হাজার ৯৩০ শিশু। গত পাঁচ বছরে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৫০ জনে। ফলে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা ছাড়িয়েছে সোয়া ১৩ লাখ। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান শেড বলছে, প্রতিদিন শত কোটি টাকার মাদক ঢুকছে রোহিঙ্গা শিবিরে। পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের কারণে বন পরিবেশ, প্রকৃতি ও সার্বিক সম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫০ হাজার কোটি টাকা।
টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মুজিবুল হক বলেন, একদিকে রোহিঙ্গাদের উপদ্র্রব অন্যদিকে মিয়ানমারে যুদ্ধ। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। অব্যাহত লোকসানে অধিকাংশ ব্যবসায়ী ঋণে জর্জরিত। একই অভিযোগ করেন কক্সবাজার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এমনকি স্থানীয় শ্রমিক-কর্মচারী, জেলে, কৃষকÑ সবার একই অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের নগ্ন থাবা পড়েছে সর্বক্ষেত্রে। এদিকে চরম সংকটাপন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এখন অপরাধের চারণভূমি। গত পাঁচ বছরে খুন হয়েছে ১১১ জন।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত ৫ বছরে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, সোনা চোরাচালান, অপহরণ, ডাকাতি, পুলিশের ওপর হামলা, হত্যা ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। উখিয়া অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রবিউল হাসান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি বা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক যারা আছেন, তারা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করেন। তারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলেন। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাই নেতাদের হত্যার জন্য টার্গেট করে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের শীর্ষ নেতা মহিবুল্লাহও ঐ সন্ত্রাসীদের হত্যার শিকার হয়েছেন।
উখিয়া পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার সভাপতি এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পের সামগ্রিক অপরাধ দমনে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কে রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এপিবিএন পুলিশের ৩টি ইউনিট কাজ করছে। সব দফতর নিয়ে একাধিক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই সতর্ক। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট্ট একটি জায়গার মধ্যে অসংখ্য লোকের বসবাস। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, এমন কোনো অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড্রোন ক্যামেরা এবং ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। সর্বশেষ গত দুই-আড়াই মাসে মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) দুই নেতাসহ অন্তত পাঁচজন খুন হন। এদের মধ্যে উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে নুরুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা যুবক খুন হন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানবপাচার ও অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধে জড়িত। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবউল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদরাসায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষকসহ ছয়জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) হারুনর রশীদ জানান, সাম্প্রতিক রাখাইনসহ কয়েকটি প্রদেশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ পরিস্থিতির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তারা সেখান থেকেই নানা অপরাধ সংগঠিত করছে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আর্মড পুলিশের তিনটি ইউনিট কাজ করছে। প্রত্যেক ব্যাটালিয়নে ৭২০ জন সদস্য নিয়োজিত আছেন। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসুদৌজা নয়ন জানান, প্রকৃত অর্থে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫২৯ জন। পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬৪টি।
এদিকে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসন ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার অফিস, প্রশাসনিক স্থাপনা করতে গিয়ে ৮ হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ সরওয়ার কামাল জানান, উখিয়া-টেকনাফের ১২ হাজার একর বনাঞ্চল উজাড় করেছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয়সহ সব মিলিয়ে বন সম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। খাদ্যাভাবে গত পাঁচ বছরে ৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। ফলে আবাসস্থল হারিয়ে বারবার হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। হাতির আক্রমণে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
Posted ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin