
নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ০৪ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
কক্সবাজারে ভ্রমণে আসবেন আর আসল কক্সবাজারের শেকড়ের সন্ধান করবেন না, তা কি হয়! তা দেখতে হলে আসতে হবে আজকের বিশ্ব নন্দিত পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার পূর্বে রামু অফিসের চরে।
সেখানে অবস্থিত ২৩৮ বছর পুরনো কক্সবাজারের প্রবক্তা ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের বাংলোবাড়ি। এখনো ওই বাড়িটি অযত্নে অবহেলায় দণ্ডায়মান রয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে। এটি পর্যটন বিনোদন কেন্দ্র ও গবেষনাগার হিসাবে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা।
১৭৮৪ সালের আগে ভারতবর্ষ ও মিয়ানমারের মাঝখানে ছোট একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল, যার নাম আরাকান। এ সময় বর্মি রাজা বোধাপায়া আরাকান দখলের জন্য অভিযানের দায়িত্ব দেন তার ছেলে যুবরাজ থাডো মিনসোকে। বর্মি যুবরাজ থাডো মিনসো সহজেই পরাজিত করেন আরাকান অধিপতিকে। আরাকান দখল করার পর বর্মিরা রাখাইনদের অত্যাচার করতে লাগল। তখন হাজার হাজার রাখাইন নাফ নদী পার হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন বর্তমানের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, পালংক্যি, হারবাং এলাকায় উদ্বাস্তু হিসেবে এল। এই রাখাইন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্যই ব্রিটিশ কূটনীতিক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে পাঠানো হয়েছিল পালংক্যিতে।
তাকে পালংক্যির মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন কক্স এখানকার নানা সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান, শরণার্থীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করেন। তিনি পালাংক্যির দুর্গম জঙ্গলি এলাকায় রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে এলাকাটি আবাদ হয়। বর্তমান কক্সবাজারের রামুতে নিজের বাসস্থান ও অফিস নির্মাণ করেন তিনি। এলাকার প্রয়োজনে সার্বিক দিক বিবেচনা করে কক্স সাহেব একটি বাজারও স্থাপন করেন তখন।
ইতিহাস গেটে জানা গেছে, বিশ্বসেরা পর্যটন স্পট আজকের কক্সবাজার নামটি ব্রিটিশ আমলের সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নাম থেকে এসেছে। বার্মা রাজা বোধাপায়া ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করেন। বোধাপায়ার ভয়াবহ অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তৎকালীন বৃটিশ শাসিত পালাংক্যিতে দলে দলে পালিয়ে আসে আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা রোহিঙ্গারা। প্রথম দিকে এ বাজারের নাম হয় কক্স সাহেবের বাজার। পরে সংক্ষিপ্ত রূপ নিয়ে তা কক্সেস বাজার বা কক্স’স (মানে কক্স-এর বাজার) হয়ে শেষতক এখন কক্সবাজার-এ রূপান্তর হয়।
রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনের সময় ১৭৯৯ সালে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স ম্যলেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার স্ত্রী ম্যাডাম কক্স পিয়ার স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে যাবার জন্য বর্তমান ডুলাহাজারা ও খুটাখালীর মধ্যবর্তী এলাকার বড় খালে জাহাজ নিয়ে আসেন। ওই জাহাজে করে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের মৃতদেহ নিয়ে যান। সেই থেকে ওই এলাকার নাম ম্যাডাম কক্স পিয়ার তথা স্থানীয় লোকমুখে মেদাকচ্ছপিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
হিরাম কক্সের বাংলোবাড়িটি বর্তমানে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বদরুদ্দীন নামের এক বৃদ্ধ সেখানে কেয়ারটেকার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এতবড় একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে গত ২৫ বছর ধরে কাজ করলেও তিনি তা জানতেন না। এখন জেনে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছেন।
অবশ্যই আপনি ও যখন জানবেন এই সেই কক্সবাজার যার প্রতিষ্ঠাতা একজন ইংরেজ সেনা কর্মকর্তা। তখন পর্যটক হিসেবে নিজেকে সার্থক মনে করবেন।
কিভাবে যাবেন: রামুর চৌমুহনী স্টেশনে নেমে রামু অফিসের চর ডাকবাংলোর নাম বললেই যে কেউ রাস্তা দেখিয়ে দেবে। দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে রাস্তার ডান পাশে যে নীরব-নিস্তব্ধ ব্রিটিশ নকশার বাড়ি দেখা যাবে, সেটিই হিরাম কক্সের বাংলো। বাংলোর চারপাশে শত শত মেহগনি আর কাঁঠালগাছ। বাংলোর ভেতরে বিশাল এক বারান্দা। হিরাম কক্স এখানে বসে অবসর সময় কাটাতেন। বারান্দার ডান পাশের ঘরে দুটি কাঠের খানদানি খাট। একটি সংযুক্ত টয়লেট। বারান্দার বাঁ পাশের ঘরটি বড়। এই ঘরে আছে একটি খাট আর সোফা।
জানা গেছে জেলা পরিষদ থেকে এসব আসবাব দেওয়া হয়েছে। হিরাম কক্সের সময়ের ভবনটি ছিল পুরো কাঠের তৈরি। জেলা পরিষদের মাধ্যমে এই বাংলোটি সেমিপাকা করা হয়েছে। ডাকবাংলোর আসল কাঠের বাংলোটি বর্তমান ঘরের মতোই দেখতে ছিল।যথাযত প্রচারণা ও পরিচর্যার অভাবে দিন দিন চাপা পড়ে যাচ্ছে কক্সবাজারের বেদিমূল।
কোথাও কোনো পরিচিতি-সাইনবোর্ড নেই,। কে জানবে! এটা হচ্ছে সেই বাংলো, যে বাংলোয় থাকতেন হিরাম কক্স, যার নামে কক্সবাজারের নামকরণ হয়েছে? বাংলোর ছাউনি পরিবর্তন ছাড়া এ পর্যন্ত ঘরের সংস্কার হয়নি। টাঙানো নেই হিরাম কক্সকে নিয়ে কোনো সাইনবোর্ড কিংবা স্মৃতিফলক। বাংলোটি ‘হিরাম কক্স এর বাংলোবাড়ি’ হিসেবে খ্যাত হলে রামুর পর্যটনে যোগ হবে নতুন মাত্রা।
কি খাবেন: রামুর চৌমুহনীতে আছে অভিজাত হোটেল। সেখানে বসে স্থানীয় তাজা শাক সবজী, হাসের মাংস আর হাসির ও ভূণাখিচুড়ি অল্প দামে খেতে পারেন।একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে।
থাকবেন কোথায়: কক্সবাজার থেকে রামুর দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। তাই মাত্র ২ ঘণ্টা সময় নিয়ে ছোট মাঝারী যে কোনো যানবাহন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। রামুর যাত্রীবাহী বাস ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৩০ টাকা। অটোরিকশা টমটম ভাড়া নেবে ৫০ টাকা করে। সকাল থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত নিরাপদে যাতায়াত করতে পারবেন। তাই সেখানে রাত যাপনের তেমন প্রয়োজন পড়ে না।তার পর ও কেউ ইচ্ছে করলে শখ করে ঐতিহাসিক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের বাংলো বাড়িতে রাত যাপন করতে চাইলে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য ৫০০ টাকা, সাধারণ লোক হলে ১ হাজার টাকা দিতে হবে।
অনেক বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক,গবেষক বছরের অধিকাংশ সময় এই বাংলো বাড়িটি পরিদর্শনে আসেন। এটি একটি আদর্শ পিকনিক স্পষ্ট ও বটে।
Posted ৫:২১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ নভেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin