
নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ০৮ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
‘দোকানে গিয়েছি ছেলের জন্য একটা ব্যাগ কিনতে। দোকানদার বলে, খুচরা টাকা ফেরত দেবে না। কারণ, আমি তো এখন অনেক ধনী, আমার খুচরা পয়সার দরকার নেই!’ বলছিলেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার বাসিন্দা অনুপ। তার অভিযোগ, দোকান, বাজার সবখানেই এখন তাকে এমন সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।
মাস দুয়েক আগে সরকারি লটারিতে প্রথম পুরস্কার জেতেন ৩২ বছর বয়সী এ যুবক। ভেবেছিলেন, হয়তো কপাল খুলে গেছে। কিন্তু লটারি জেতার খবর ছড়িয়ে পড়তেই চারপাশের সব হঠাৎ এমনভাবে বদলে গেছে, যা ছিল তার চিন্তারও বাইরে।
এখন তিনি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছেন না। বের হলেই মানুষ চিনে ফেলছে। যার সাথেই দেখা হয়, প্রায় প্রত্যেকেই তার কাছে টাকা চায়। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেকেই তার ওপর ক্ষিপ্ত।
অনুপ আক্ষেপ করে বলেন, একসময় যারা ঘনিষ্ঠ ছিল, তাদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
কেরালা রাজ্য সরকারের লটারিতে ২৫ কোটি রুপির প্রথম পুরস্কার জেতার পর গত সেপ্টেম্বর মাসে অটোচালক অনুপকে নিয়ে হইচই পড়ে যায় সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। কেরালায় লটারিতে এত টাকা জেতার ইতিহাস নেই।
কিন্তু লটারি জেতার খবর সংবাদমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার হওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অনুপের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তবে এই ভিডিও’র মেজাজ ছিল একদম আলাদা। সেখানে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল না। ছিল বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি তার কাতর অনুরোধ- তাকে যেন আর হয়রানি করা না হয়।
কপাল খোলার মাত্র কয়েকদিনের মাথায় অনুপ বলছেন, এই জ্যাকপট, এই বিশাল অর্থ না জেতাই বুঝি ভালো ছিল।
গত সপ্তাহে বিবিসি যখন অনুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে প্রতিবেদনের সঙ্গে ছবি না প্রকাশের শর্তে রাজি হন। কারণ তার দাবি, প্রতিবার সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরেই আবার নতুন করে বিড়ম্বনার ঢেউ ওঠে।
টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই ভারতীয় যুবক বলেন, আপনি এর মধ্যে দিয়ে না গেলে বুঝবেন না এই বিড়ম্বনা কতটা চাপের। এ যেন কোনো সিনেমার দৃশ্য। হঠাৎ চেনা-পরিচিত সবাই আপনার বাসায় ভেঙে পড়েছে।
কে এই অনুপ?
কেরালার তিরুভানান্তাপুরমের বাসিন্দা অনুপ বি (পুরো না দেওয়া হয়নি) একসময় রাঁধুনীর কাজ করতেন। সেই পেশা ছেড়ে পরে অটো চালানো শুরু করেন। গত ১০ বছর ধরে ভাগ্য ফেরাতে তিনি নিয়মিত লটারির টিকিট কিনে যাচ্ছিলেন। আগে ছোটখাট অর্থও জিতেছেন। কিন্তু এবারে একেবারে প্রথম পুরস্কার– ২৫ কোটি রুপি!
কিন্তু ভাগ্য ফেরার আনন্দ উপভোগ করার বদলে এখন প্রতিদিন মানুষের হয়রানি সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অনুপকে। লটারি জেতার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে তার বাসায় শত শত মানুষ আসছে সাহায্য চাইতে।
তিনি বলেন, ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাসার বাইরে মানুষের ভিড়। ভোর ৫টা থেকে শুরু হয়ে যায় লোকজন আসা, বসে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত।
অনুপের স্ত্রী মায়া স্থানীয় একটি সংবাদ চ্যানেলকে বলেছেন, মানুষকে সাহায্য করার বিষয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেটি লটারির অর্থ হাতে পাওয়ার পর।
মায়া বলেন, লোকজন সব ব্যাপারেই আমাদের কাছে অর্থসাহায্য চাইতে আসছে। কেউ চায় বাড়ি কেনার বন্ধকী ঋণ, কেউ চায় আমরা যেন অন্য ঋণ পরিশোধের জন্য টাকা দেই। কেউ আবার তাদের কন্যার বিয়ের খরচ চাইতে আসছে।
নানা ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির দালালরাও অনবরত ফোন করছে। এমনকি চেন্নাই থেকে একটা দল এসে সিনেমা বানানোর জন্য টাকা দিতে বলেছে বলে জানান অনুপ।
কেউ কেউ হয়তো আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সুবাদে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করছেন। কিন্তু এমন মানুষও আসছেন, যাদের তারা চেনেনও না। তবু ওই লোকগুলোর বিশ্বাস, এই অর্থে নাকি তাদেরও ন্যায্য দাবি রয়েছে।
অনুপ বলেন, এক ব্যক্তি আমার বাড়ির বাইরে সারা দিন বসেছিল। তার দাবি, আমি যেন তাকে রয়্যাল এনফিল্ড ব্র্যান্ডের মোটরবাইক কিনে দেই।
তিনি বলেন, প্রত্যেকেই মনে করছে, আমি এই টাকা মাগনা পেয়ে গেছি। আমাকে তো এর জন্য কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি। তাই তাদের প্রশ্ন, আমি কেন তাদেরও এর ভাগ দেবো না?
অনলাইন গুজব
রয়েছ অনলাইনে ছড়ানো গুজবের যন্ত্রণাও। অনুপ বলেন, লটারি জেতার পর সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, লটারি জেতার বিষয়ে আমি মিথ্যা বলেছি। আমার আগে থেকেই অঢেল টাকা ছিল এবং এই লটারি জেতাটা জালিয়াতি মাত্র।
ভুক্তভোগী এ যুবক জানান, এখন তিনি মানুষের সামনে যেতেই ভয় পাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি যেখানেই যাই, মানুষ আমাকে চিনে ফেলে। কারণ এতগুলো নিউজ চ্যানেলে, ওয়েবসাইটে আর সংবাদপত্রে তারা আমার চেহারা দেখেছে।
স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন অনুপ। তার স্ত্রী এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের ছোট একটি ছেলেও রয়েছে।
‘বন্ধু হয়ে যায় শত্রু’
লটারি জেতার পর এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা শুধু অনুপেরই হয়নি। গত অক্টোবর মাসে স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলের গেমস শোতে অংশ নেওয়ার সময় অনুপের সাথে আলাপ হয় ৫৯ বছর বয়সী জয়াপালানের। গত বছর একই লটারিতে প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। সে বছর প্রথম পুরস্কারের অর্থ ছিল ১২ কোটি রুপি। সেটি নিয়েও মিডিয়ায় বেশ হইচই হয়েছিল এবং জয়াপালানও অর্থ সাহায্যের অনুরোধে জর্জরিত হয়ে পড়েন।
জয়াপালান বলেন, এত হয়রানির মধ্যে বোঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল, সাহায্য আসলেই কার দরকার আর কার দরকার না। তিনি বলেন, এসময় বন্ধুও শত্রু হয়ে যায়। অনেকে এখনো আমার ওপর ক্ষেপে রয়েছে তাদের টাকা দেইনি বলে।
এমনকি হুমকি-ধামকি দিয়ে চিঠি পাওয়ার পর জয়াপালান পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতেও বাধ্য হন। বাসার চারপাশে লাগাতে হয় সিসি ক্যামেরা। তাই অনুপকে জয়ের অর্থ নিয়ে ‘খুব সতর্ক’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অনুপ বলেন, লোকে মনে করে, ও লটারি জিতেছে আর কী! টাকা নিয়ে তো ওর এখন আর কোনো চিন্তা নেই। অথচ এখনো সবকিছুই অনিশ্চিত। আমি তো জানিও না, কর দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত কত হাতে পাবো।
ভারতের অনেক রাজ্যেই লটারি অবৈধ। কেরালাসহ কিছু রাজ্যে এটি বৈধ হলেও লটারি প্রকল্প চালানোর ক্ষেত্রে নানা কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। আবার, লটারিতে জেতা অর্থের কতটা বিজয়ীর হাতে যাবে তার হিসাব-নিকাশও বেশ জটিল।
প্রথমত, রাজ্য সরকার পুরস্কারের অর্থ দেওয়ার সময়ই ৩০ শতাংশ কর বাবদ কেটে নেবে। এরপর টিকিট বিক্রি করেছে যে সংস্থা, তারা তাদের কমিশন কাটবে। এর ওপর বিজয়ীকে এই পুরস্কার বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারকে বাড়তি সেস কর এবং সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে।
অনুপ বলেছেন, এই অর্থ দিয়ে তিনি কী করবেন, সে বিষয়ে আগামী কয়েক বছরের আগে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, এই অর্থ যে আমার জন্য আর্শীবাদ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আর কাউকে সাহায্য করার আগে আমি এই অর্থ এমনভাবে ব্যবহার করতে চাই, যাতে আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। আমার পরিবার যেন স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, সেটাই প্রথম লক্ষ্য।
সূত্র: বিবিসি
Posted ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৮ নভেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin