
নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ১১ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাসিক থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে সুরগানা তালুকের ছোট গ্রাম দান্ডিচি বারি। গোটা গ্রামে মেরেকেটে ৩০০ জনের বাস। কিন্তু এই গ্রামে কোনো পুরুষের বিয়ে হলে আনন্দ করার বদলে প্রমাদ গোনেন সেই পরিবার এবং গ্রামের বাকিরা।
বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও সুখী সাংসারিক জীবন কেমন হয়, তা এই গ্রামের অনেক পুরুষই জানেন না। কারণ এই গ্রামের বেশির ভাগ নারীই বিয়ের পরপরই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে এমনি এমনি না। বিশেষ এক কারণে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন এই গ্রামের নববধূরা।
দান্ডিচি বারি গ্রামের বাসিন্দারা সারা বছরই পানীর সমস্যায় ভুগতে থাকেন। পানির তীব্র কষ্টের মধ্যে থাকলেও যারা এই গ্রামে বড় হয়েছেন, তারা এই জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত। কিন্তু সমস্যায় পড়েন তারা, যারা বাইরে থেকে এই গ্রামে আসেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই নববিবাহিতা।
শ্বশুরবাড়িতে কিছু দিন কাটানোর পর তারা পানীর সংকট নিয়ে এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে, এই গ্রামে থাকতে চান না। বিয়ে-স্বামী-শ্বশুরবাড়ি সব ফেলে ফিরে যেতে চান বাপের বাড়ি।
এই গ্রামের বাসিন্দা গোবিন্দ ওয়াঘমারে এ রকমই একটি বিয়ের কথা শুনিয়েছেন, যা মাত্র দুই দিন টিকেছিল। গোবিন্দ বলেন, ‘২০১৪ সালে গ্রামের একজনের বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়ে মাত্র দু’দিন স্থায়ী হয়েছিল। দু’দিনের মাথায় স্বামীর ঘর ছাড়েন ওই বধূ। এই ঘটনা লোকমুখে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।’
গোবিন্দ আরও জানান, পানি আনার জন্য ওই নববধূ গ্রামের বাকি গৃহবধূদের সঙ্গে পাহাড়ের নীচে গিয়েছিলেন। এক দিন পানি আনতে গিয়েই বুঝে গিয়েছিলেন যে, এই গ্রামে বসবাস করা কতটা কঠিন।
অনেকটা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত গিয়ে পানী আনতে হয় গ্রামের মহিলাদের। ওই নববধূ বুঝে গিয়েছিলেন, ওই গ্রামে থাকলে তার জীবন কঠিন হয়ে যাবে। পালানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। তাই পানি আনতে গিয়ে সেখানেই কলসি রেখে ওই বধূ বাপের বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলেন।
গোবিন্দ আরো জানিয়েছেন, এই গ্রামের মহিলাদের প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ মার্চ থেকে জুন মাস দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পাহাড়ের নীচে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া একটি নদী থেকে পানি আনতে হয়। শুকনো নদীর সামনে থাকা পাথরের ফাটল থেকে গ্রামের গৃহবধূদের পানি ভরতে হয়। নদীর ধারে থাকা পাথরের ফাটলে হাত ঢুকিয়ে একটি বাটি দিয়ে সেই পানি তুলে পাত্রে ভরতে হয়।
ফাটলের ভেতরের পানি ফুরিয়ে গেলে সেই পানি আবার ভর্তি হওয়ার জন্য মহিলাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এরপর দুটি করে পাত্র মাথায় চাপিয়ে তাদের আবার পাহাড় ডিঙিয়ে গ্রামে ফিরতে হয়।
গ্রামের মহিলারা দিনে দুই বার পাহাড়ের নীচে পানি আনতে যান। ভোর ৪টা থেকে পানি আনার তোড়জোড় শুরু হয়। একবার পানি আনার পর বিকাল বেলায় আবার পানি আনতে যেতে হয়। গ্রীষ্মকালে বেশির ভাগ দিনই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে। সেই গরমেই পাথুরে রাস্তা হেঁটে পেরোতে হয় গ্রামের মহিলাদের।
গ্রামের এক বাসিন্দা লক্ষ্মীবাই ওয়াসলে বলেন, ‘একটি কলসি পূর্ণ হতে তিন ঘণ্টাও লাগতে পারে। পানি ভরে ফিরতে অনেক সময়েই রাত হয়ে যায়।’ লক্ষ্মীবাই জানান, রাতের অন্ধকারে বন্য প্রাণীদের হামলার ভয়ও থাকে। সেই কারণে রাতে ফেরার সময় মশাল জ্বালিয়ে বাড়ি ফেরেন তারা। সঙ্গে থাকে টর্চও।
খাড়াই রাস্তা ধরে মাথায় দুটি কলসি এবং হাতে টর্চ জ্বেলে বাড়ি ফেরেন গ্রামের মহিলারা। শুধু পানি ভরতে যাওয়া নয়, বাড়ির অন্যান্য কাজও করতে হয় মহিলাদেরই। এই কষ্টকর জীবন কাটাতে রাজি থাকেন না অনেক মহিলাই। এই কারণে বউ হয়ে আসার পর অনেক নববধূ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান।
দান্ডিচি বারি গ্রামের প্রধান জয়রাম ওয়াঘমারে জানান, তিনি অনেক দিন ধরেই গ্রামের মানুষদের জন্য পানির ট্যাংক বসানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে এসে আমাদের কষ্টের ছবি তোলেন। কিন্তু কেউ সাহায্য করেন না। আমাদের গ্রাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খরায় ভুগছে।’
জয়রাম স্বীকার করেন যে, বিয়ে না টেকার ব্যাপারে এই গ্রামের বদনাম রয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে তিনজন বিবাহিত মহিলা পানির অভাবে বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রাম ছেড়েছিলেন।
এখন অনেক পরিবারই তাদের মেয়েদের এই গ্রামের পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হন না। জয়রাম বলেন, ‘একবার যখন কেউ জানতে পারেন যে বরের বাড়ি দান্ডিচি বারিতে, তখনই তারা বিয়ের আলোচনা বন্ধ করে দেন।’
সূত্র: আনন্দবাজার
Posted ৬:২১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ নভেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin