
নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
তাকে বলা হয় ফুটবলের বরপুত্র। সর্বকালের সেরার বিতর্কে তার সঙ্গে পেলের দ্বৈরথ চিরকালীন। ফুটবলের খেয়ালি এই শিল্পী বলপায়ে এমনভাবে মোহিত করেছেন বিশ্ববাসীকে যে, আজও তার নাম উচ্চারিত হলে চোখের সামনে ভাসে বলপায়ে এক শিল্পীর অবিশ্বাস্য সব কারিকুরি। বিশ্বকাপকে তার মতো করে রঙিন করতে পেরেছেন খুব কম খেলোয়াড়ই। জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রেম আর বিতর্ক ছড়িয়েছেন ফুটবলের দ্রোহের নায়ক। তিনি আর্জেন্টিনার শেষ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
একনজরে ম্যারাডোনা:
পুরো নাম: ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা
জন্ম: ৩০ অক্টোব ১৯৬০, লানাস, আর্জেন্টিনা
পজিশন: অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার/সেকেন্ড স্ট্রাইকার
জাতীয় দল: আর্জেন্টিনা (৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল)
বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স: ৮ গোল
ম্যারাডোনার পরিচয় দিতে গেলে দুটি পরিচয় সামনে চলে আসে। প্রথমত, তিনি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। ’৮৬ বিশ্বকাপের ‘ম্যারাডোনা’ এক অতিমানবীয় ফুটবল জাদুকর। যার পায়ের নিচে চূর্ণ হয়েছে ইংলিশদম্ভ। আরেক ম্যারাডোনা হলেন ‘ঈশ্বর’। ইতালির নেপলস শহরের মানুষের কাছে তিনি ‘ঈশ্বর’। তিনি শহরটির রাজা। ঈশ্বর যেমন পূজিত হন প্রার্থনাগৃহে, তেমনি এই ফুটবল-ঈশ্বরের পূজা চলে ইতালির শহরটির ঘরে-ঘরে, হৃদয়ে-হৃদয়ে। তার ছবি শোভা পায় নেপলসের দেয়ালে।
আর্জেন্টিনার শহর লানাসে ১৯৬০ সালে জন্ম নেয়া ম্যারাডোনা শিশু বয়স থেকেই পেয়েছেন তারকাখ্যাতি। মাত্র ১১ বছর বয়সেই খেলোয়াড়ি প্রতিভার জন্য জায়গা পান পত্রিকার প্রথম পাতায়, আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের হয়ে খেলতে গিয়ে। ব্রাজিলিয়ান প্লেমেকার রিভেলিনো ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উইঙ্গার জর্জ বেস্ট তার শৈশবের ফুটবলীয় আদর্শ।
১৯৭৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের হয়ে সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। প্রিমেরা ডিভিশনে অভিষেকের কয়েক মুহূর্ত পরই হুয়ান ডোমিঙ্গো ক্যাবরেরাকে নাটমেগ করে নিজের প্রতিভার প্রমাণ রাখেন তিনি। মিডফিল্ডার হয়েও ক্লাবটির হয়ে ১৬৬ ম্যাচে ১১৬ গোল করেন ম্যারাডোনা।
১৯৮১ সালে তিনি যোগ দেন আর্জেন্টিনার সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে। ক্লাবটির হয়ে ৪০ ম্যাচে ২৮ গোল করেন তিনি।
১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের পর ম্যারাডোনা যোগ দেন লা লিগার ক্লাব বার্সেলোনায়। ক্লাবটির হয়ে তিনি কোপা দেল রে-র শিরোপা জেতেন। ম্যারাডোনাই প্রথম বার্সেলোনা খেলোয়াড়, যিনি রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে রিয়াল সমর্থকদের স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশন পান।
এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদের গোলরক্ষক অগাস্টিনকে কাটিয়ে ম্যারাডোনা গোলবারে শুট না করে অপেক্ষা করেন ডিফেন্ডারদের। মাদ্রিদ ডিফেন্ডার হুয়ান হোসে তাকে স্লাইডিং ট্যাকেল করতে এলে তিনি গোল করেন। তার এমন ব্যবহার মুগ্ধ করে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়-দর্শক সবাইকে। ম্যারাডোনার পর রোনালদিনহো ও আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরা এমন সম্মান দেখিয়েছিল।
বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন ম্যারাডোনা। তবে বার্সেলোনাতে এসেই কোকেনের সঙ্গে পরিচয়টা শুরু হয়েছিল তার। বার্সার হয়ে ভালো করলেও ক্লাবটাকে নিজের ঘর মনে করতে পারছিলেন না তিনি। ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগ দিয়ে ম্যারাডোনা খুঁজে পান নিজের ঘর। এখানেই তার লার্জার ড্যাং লাইফ হয়ে ওঠা।
ইতালির গেয়ো শহর নেপলসের ফুটবলে ছিল না তেমন খ্যাতি। তুরিন-মিলানের ফুটবল গ্লোরির সামনে নাপোলি রীতিমতো ম্লান। সেই নাপোলি ম্যারাডোনাকে দলবদলের রেকর্ড গড়ে ক্লাবে নিয়ে এলে ৮৫ হাজার সমর্থক তাকে বরণ করে নিতে উপস্থিত হন। নেপলসে ফুটবল, মাফিয়া, নারী আর ড্রাগস মিলিয়ে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন ইতালিতে এক রোমাঞ্চকর চরিত্র।
নাপোলিতে ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছিলেন শতভাগ নেপলিতানিয়ান। মাঝারি ক্লাবটিকে দুবার লিগ শিরোপা এনে দিয়ে মিলান-তুরিনের অহং চূর্ণ করার জন্যই শুধু নয়; ক্লাবটির প্রতি, শহরটার প্রতি তার ভালোবাসাও ছিল অন্য মাত্রার। ক্লাবটিতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে ২৫৭ ম্যাচে ১১৫ গোল আর ৬৩ অ্যাসিস্টে নাপোলিকে ৫টি শিরোপা উপহার দিয়ে শহরবাসীর কাছে ঈশ্বর সমতুল্য হয়ে ওঠেন তিনি। তবে শেষটা মোটেও সুখের হয়নি তার।
১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইতালির। আর খেলাটা পড়ে ম্যারাডোনার ক্লাব নাপোলির মাঠেই। ম্যাচের আগে তাই ঘরের ছেলে হিসেবে ম্যারাডোনা সমর্থন চান নেপলসবাসীর।
ম্যাচে ইতালিকে হারিয়ে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠে। শহরবাসী তাতে দুঃখ পান। এই জয় রাগিয়ে দেয় নেপলসবাসীকে। এর সঙ্গে ড্রাগ আর নারী কেলেঙ্কারিতে ক্লাব ছাড়তে হয় তাকে। এরপর আর কখনো নেপলসে ফেরা হয়নি তার। ট্যাক্স ফাঁকির মামলার দণ্ড মাথায় নিয়ে ইতালিতে আর কখনোই পা রাখতে পারেননি তিনি। তবে নেপলসবাসী তাকে ভোলেননি। ভোলেনি ক্লাব নাপোলিও। তাইতো নিজেদের ঘরের মাঠের নাম রেখেছেন ম্যারাডোনার নামেই।
ম্যারাডোনার ফুটবল বিধাতা হয়ে ওঠার অন্যতম উপলক্ষ হয়ে এসেছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপ। এর আগে ১৯৮২ বিশ্বকাপেও ছিলেন তিনি। সে সময় তরুণ প্রতিভা ম্যারাডোনা করতে পারেননি নামের প্রতি সুবিচার। পাঁচ ম্যাচের প্রতিটিতে খেলে শুধু হাঙ্গেরির বিপক্ষে করেছিলেন ২ গোল। আসরজুড়ে প্রতিপক্ষের ফাউলের শিকার হয়ে মেজাজ হারিয়েছিলেন তিনি। শেষ ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে ক্রমাগত ফাউলের শিকার হচ্ছিলেন তিনি। বাজে রেফারিংয়ের সঙ্গে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকায় মেজাজ হারান ম্যারাডোনা। ম্যাচ শেষের ৫ মিনিট আগে বাতিস্তাকে মারাত্মক ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন তিনি।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে বড্ড সাদামাটা দল নিয়ে বিশ্বকাপে যায় আলবিসেলস্তেরা। তবে দলটার নেতা ম্যারাডোনা বিগত আসরের ব্যর্থতা ভুলে তখন পরিণত মেজাজের বিশ্বসেরা খেলোয়াড়।
ছিয়াশির বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পারফরম্যান্স এতই প্রভাবশালী ছিল যে বলা হয়, বিশ্বকাপে এমন আধিপত্য দেখিয়ে আর কেউই বিশ্বকাপ জয় করেনি। প্রতিটি ম্যাচের প্রতিটি মিনিট খেলেন তিনি। ৫ ম্যাচে ৫ গোল করা ম্যারাডোনা অ্যাসিস্টও করেন ৫টি।
অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে ফাইনালে নামার আগে ম্যারাডোনা সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে তখন ফকল্যান্ড যুদ্ধ নিয়ে আর্জেন্টিনার সম্পর্ক একদম তলানিতে। সদ্যই যুদ্ধহারের ক্ষত বুকে নিয়ে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা। ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই মিডিয়ায় এই ম্যাচ ছড়াচ্ছিল উত্তাপ। মাঠের খেলায়ও পড়ে তার রেশ।
এই ম্যাচেই হয়তো ম্যারাডোনা নিজের ফুটবল দক্ষতার সবটুকু দেখিয়েছেন। অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনা করে বসেন বিতর্কিত এক কাণ্ড। হাত দিয়ে করেন গোল। উড়ে আসা বলটিতে হেড করতে গিয়ে নাগাল না পেয়ে ম্যারাডোনা হাত দিয়ে গোলে ঢুকিয়ে দেন বল। বিষয়টি টের পান ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটন। রেফারির কাছে তিনি অভিযোগ জানালেও রেফারি তা আমলে নেননি।
তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার দ্বিতীয় গোলে দেখা মেলে ফুটবলীয় স্কিলের সর্বোচ্চ। নিজেদের অর্ধ থেকে দৌড় শেষ করে ইংল্যান্ডের ছয় খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল করেন তিনি। একই ম্যাচে এমন দুই গোলের পর ফরাসি দৈনিক লা ইকুইপে ম্যারাডোনার বিষয়ে মন্তব্য করে: ‘অর্ধেক ঈশ্বর, অর্ধেক শয়তান।’
ফাইনালে জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। এটিই আলবিসেলেস্তেদের শেষ বিশ্বকাপ। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠে। সে আসরে অবশ্য ম্যারাডোনা ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। শেষ পর্যন্ত ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে রানার্সআপ হয় আর্জেন্টিনা।
১৯৯১ সালে প্রথমবার কোকেন আসক্তির জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হন ম্যারাডোনা। তবে পরবর্তী সময়ে ফের ফুটবলে ফেরেন। ১৯৯৪ সালে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যান ম্যারাডোনা। প্রথম দুই ম্যাচ খেলে গ্রিসের বিপক্ষে একটি গোলও করেন। তবে এরপরই সারা বিশ্ব হতবিহ্বল হয়ে পড়ে একটি ঘটনায়। নিষিদ্ধ ড্রাগ এফেড্রিন গ্রহণের কারণে ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন তিনি। ফলে নিষিদ্ধ হন ফুটবল থেকে। বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে ফিরে আসতে হয় তাকে।
ক্যারিয়ারে নারী-মাদক-বিতর্কের পাশেই ফুটবলের ফুল ফুটিয়েছেন খেয়ালি রাজপুত্র ম্যারাডোনা। দ্রোহী সত্তার কারণে সবসময় সোচ্চার ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধেও। আসক্তি কাটিয়ে চেষ্টা করেছেন ফুটবলে ফিরতে। ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে এসেছিলেন ফিরে বিশ্বকাপের মঞ্চে। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে এক হালি গোল খেয়ে বিদায় নেয় তার দল।
শরীরের ওপর চালানো অত্যাচার আর আসক্তির ফল খুব একটা ভালো কিছু এনে দেয়নি তাকে। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তবে যার কাছে বেঁচে থাকার মানে লার্জার দ্যান লাইফ, তাকে জন্ম-মৃত্যুর গণ্ডিতে আটকাতে পারে কে!
Posted ৮:২০ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin