
নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ কেবল বেমানানই নয়, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও ব্যাপক। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। নয় মাস ধরে চলমান এই যুদ্ধ আগে থেকেই সংকটে থাকা বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ে গেছে ভিন্ন এক বাস্তবতায়, দেখা দিয়েছে মন্দার শঙ্কা। বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সীমান্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রভাব ফেলেছে সবার ওপর। কিন্তু আসলেই কি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ যখন জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত, ঠিক তখন এই সংকটকে পুঁজি করেই ব্যবসা করছে অনেকে। এক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সংকট থেকে সুস্পষ্টভাবে লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের নয় মাস পর এসে পশ্চিমা দেশগুলোকে নানা ক্ষেত্রে নতুন পরীক্ষার মুখে ফেলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত শীর্ষ ইউরোপীয় কর্মকর্তারাও বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ইইউভুক্ত দেশগুলো যখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন সেই যুদ্ধকে পুঁজি করে জ্বালানি ও অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে ওয়াশিংটন।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম পলিটিকো-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে শীর্ষ একজন ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলেন, ‘গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যায়, এই যুদ্ধ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান দেশটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। কারণ তারা যেমন বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করছে, তেমনি বেশি বেশি অস্ত্রও বিক্রি করছে।’
এমন বিস্ফোরক মন্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সিনিয়র কূটনীতিকরাও। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অতি মুনাফার লালসা’ ইউরোপীয় শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার পশ্চিমা মিত্রদের এমন বিভেদ স্বাভাবিকভাবেই খুশি করছে ক্রেমলিনকে।
ইউরোপের এমন উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘যথাযথ প্রতিক্রিয়া’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কূটনীতিক জোসেপ বোরেল। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এমন সিদ্ধান্ত না নেয়া, যা পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যদিও ইউরোপের এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসন এবং ইউরোপের বিরুদ্ধে তার ‘জ্বালানি যুদ্ধের’ কারণেই এ অঞ্চলে গ্যাসের দাম বেড়েছে। তার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের রফতানি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে, যা ইউরোপকে রাশিয়া নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করছে।
একই সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয় অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি জ্বালানি ঘাটতিতে প্রায় দিশেহারা ইউরোপের দেশগুলো এখন ব্যস্ত সংকট এড়ানোর বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে। রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস আমদানির দিকে ঝুঁকলেও, এজন্য তাদের খরচ হচ্ছে প্রায় চারগুণ বেশি। এছাড়া ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিতে গিয়ে নিজেরাই কিছুটা বিপাকে পড়েছে ইউরোপীয় সেনাবাহিনী। ফলে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জামের জন্য তাদের এখন নির্ভর করতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। কিন্তু সেখানেও ব্যবসা করতে ছাড়ছে না দেশটি।
ব্রাসেলস ছাড়াও বিষয়টিকে ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবেই দেখছেন ইইউর নেতারা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আচরণ নয়। আর ওয়াশিংটনকে আরও ‘সংহতি’ দেখিয়ে জ্বালানির দাম কমাতে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছে জার্মানি।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে ইইউ নেতারা গ্যাসের উচ্চ মূল্য নিয়ে বাইডেনকে তাদের উদ্বেগের কথা জানালেও, এ বিষয়ে তিনি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি বলেও অভিযোগ অনেকের। কূটনীতিকদের শঙ্কা, সংকট নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন ‘উদাসীনতা’ ইউরোপের জন্য বড় সমস্যা বয়ে আনতে পারে।
আটলান্টিকের দুই পাড়ের কর্মকর্তারাই পশ্চিমা জোটের ঐক্য নিয়ে ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করছেন। আর পুতিন যে ঠিক এই বিভেদই তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তা নিয়েও দ্বিমত নেই ইইউ এবং মার্কিন কূটনীতিকদের।
‘মুনাফাখোরদের’ বিষয়ে বাইডেনের অবস্থান
যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রেকর্ড মুনাফা করায় তেল কোম্পানিগুলোকে সম্প্রতি ‘যুদ্ধের মুনাফাখোর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পাশাপাশি গ্রাহকদের খরচ কমাতে ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্রে এ শিল্পের ওপর উচ্চ কর আরোপ (উইন্ডফল ট্যাক্স) করতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। বেড়ে যায় তেল এবং পেট্রলের দাম, যার সঙ্গে বাড়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর আয়। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই এই খাতে উচ্চ কর আরোপের কথা জানান বাইডেন।
হোয়াইট হাউসে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, তেল কোম্পানিগুলো যুদ্ধের অগ্নিপ্রবাহ, ইউক্রেনকে ধ্বংসকারী নৃশংস সংঘাত এবং এ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট থেকে লাভ তুলছে। এসব কোম্পানির নির্বাহী এবং শেয়ারহোল্ডারদের উচিৎ ‘সংকীর্ণ স্বার্থ’ পরিত্যাগ করে তাদের ক্রমবর্ধমান মুনাফাকে তেল উৎপাদন এবং পরিশোধন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা।
মার্কিন ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান সেন. রন ওয়াইডেন সম্প্রতি একটি বিল উত্থাপন করেছেন, যেখানে বার্ষিক রাজস্ব ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি এমন বড় তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর ‘অতিরিক্ত’ লাভের ওপর ২১ শতাংশ ট্যাক্স প্রয়োগের কথা বলা হয়।
যদিও নিজেদের অতিরিক্ত মুনাফার পক্ষে সাফাই দিয়ে তেল কোম্পানিগুলো বলছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তির বাজারে লাগা ধাক্কা থেকেই তাদের এ মুনাফা হয়েছে।
তেল নিয়ে তিক্ততা
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সেই সম্পর্কে সম্প্রতি চিঁড় ধরেছে।
অক্টোবরের শুরুতে সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক তেলের উৎপাদন কমানোর পর, সৌদি আরবকে এজন্য ‘কঠিন পরিণাম’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন ওয়াশিংটনের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং সৌদিসহ ওপেকের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ এমন সব পদক্ষেপের হুমকি দিচ্ছেন, যা কিছুদিন আগে কল্পনাও করা যায়নি। এমনকি নিজেদের মধ্যকার এ বিরোধ লুকানোর চেষ্টা না করে জ্বালানি সংকটসহ নানা ইস্যুতে প্রকাশ্যেই একে অপরকে দুষছে দেশ দুটি।
‘গোপন চুক্তি’
গত জুলাইয়ে বাইডেন সৌদি সফরে গিয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন বাইডেন। এ সফর ঘিরে বেশ সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের আশা ছিল, বাইডেনের সফরের পর চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত তেল সরবরাহ ঠিত রাখতে তারা সৌদি আরবের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন।
কিন্তু তাদের এ ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে সালমান-বাইডেনের বৈঠকের পর ওপেক এবং এর মিত্র হিসেবে পরিচিত ওপেক প্লাস প্রতিদিন মাত্র এক লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন শুরু করে। অনেকে ওপেকের এ পদক্ষেপকে বাইডেন প্রশাসনের জন্য চরম অপমানজনক বা ‘স্ল্যাপ ইন দ্য ফেস’ হিসেবেও বর্ণনা করে থাকেন।
এছাড়া অক্টোবরের শুরুতে তেলের উৎপাদন দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল কমানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করে ওপেক প্লাস। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে যা তেল ও পেট্রলের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ
অক্টোবরের শুরুতে ওপেক প্লাসের এক সংবাদ সম্মেলনে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ থেকে বিপুল পরিমাণ জরুরি তেলের রিজার্ভ ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে বাইডেনের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন সৌদির জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন সালমান।
তিনি বলেন, ‘আমি এটাকে বিকৃতি বলব না। প্রকৃতপক্ষে সঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এমন সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে পরিস্থিতি আজকের তুলনায় ভিন্ন হতে পারত।’
কিন্তু এমন বক্তব্যের মাত্র তিন সপ্তাহ পরই ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেন সৌদির জ্বালানিমন্ত্রী আব্দুল আজিজ বিন সালমান। অপর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘অনেকে নিজেদের জরুরি রিজার্ভ থেকে তেল ছাড় করছে। এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ ছিল, সরবরাহ ঘাটতি মেটানো। কিন্তু কেউ কেউ তা করছে বাজার কারসাজির উদ্দেশে। বিশ্বের কাছে এটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, জরুরি রিজার্ভ থেকে তেল ছাড় করার মতো এমন পদক্ষেপ আগামীতে বেদনাদায়ক হতে পারে।’
মন্দার শঙ্কা
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা যে আসন্ন তা প্রমাণের জন্য খুব বেশি পেছনে তাকানোর প্রয়োজন নেই। সম্প্রতি হাউজিং মার্কেটে ধস নেমেছে, উল্টে গেছে বন্ড মার্কেটের বক্ররেখা। আর ফেডারেল রিজার্ভের অনুমান, ২০২৩ সালে বাড়বে বেকারত্বের হার। যার সবই মন্দার দিকে ইঙ্গিত করে। আলোচনায় তেমন না থাকলেও, সম্ভাব্য মন্দার পেছনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে তেলের বাজার।
বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা নিরুপণের জন্য সুপরিচিত সংস্থা– যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাভিত্তিক নেড ডেভিস রিসার্চ। তাদের গবেষণা মডেল অনুসারে, আগামী বছরে মন্দার ঝুঁকি এখন ৯৮.১ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনা মহামারিজনিত মন্দা এবং ২০০০-০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর যা সর্বোচ্চ।
তবে বড় শঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার বাড়াতে থাকায় মন্দার গ্রাসেই পড়তে যাচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতিটি। আর মার্কিন তরী ডুবলে, তারা বাকি বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে ডুববে বলেই শঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এছাড়াও ইউরোপের বৃহত্তম তিন অর্থনীতি– জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্য আগামী বছর দীর্ঘমেয়াদি মন্দার কবলে পড়বে বলে শঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহে ধস নামাকেই এর মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
Posted ৪:২৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin