
নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
ফ্রান্সের ইতিহাসে যদি কোনো দুর্ভাগা ফুটবলারের তালিকা থাকে তাহলে করিম বেনজেমার নামটা সবার উপরেই থাকবে। রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলতে এসেও পারেননি খেলতে। দুরন্ত ফর্ম নিয়ে যখন কাতার বিশ্বকাপে সবে নামার পালা, তখনই দেখা দিলো তার ইনজুরি। তাতে ছিটকে গেলেন আসর থেকেই। আর এবার ফুটবলকেই বিদায় বলে দিলেন ব্যালন ডি’অর জয়ী এই ফরাসি তারকা। তার এই বিদায়টা কি অভিমানের না অপমানের না এর পেছনে অন্যকিছু রয়েছে। হয়তো সময় সেটা জনানা দেবে।
বিশ্বকাপ শুরুর দু’দিন আগে ইনজুরিতে পড়েন বেনজেমা। যে কারণে ছিটকে পড়েন পুরো বিশ্বকাপ থেকেই। যদিও ফ্রান্স স্কোয়াড থেকে তার নাম কাটা হয়নি। এরই ফাঁকে সুস্থ হয়ে যান করিম বেনজেমা। আশা ছিল, ফাইনালে তাকে ডাকবেন কোচ দিদিয়ের দেশম। তবে সেসবের কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না।
করিম বেনজেমার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে দুটো রং চোখে পড়বে। যার একপাশে কালো , বাকি অংশে রংধনুর সকল রং। এরচেয়ে আরো গভীরভাবে বেনজেমার ক্যারিয়ার ব্যাখা করা গেলে সেটা হবে আলো-আধারীর গল্প। যার একপাশে আঁধার হলে অন্যপাশে বাকি সময়টায় আলো জ্বালিয়েই গেছেন এই ফরাসি ফুটবলার।
শৈশবে অভিবাসী পরিবারের সন্তান বেনজেমার পা আগলে ধরেছে বৈষম্য। স্কুলে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিকঠাক মিশতে পারতেন না। বৈষম্যের শিকারও হয়েছেন। ওজনের জন্যও শুনতে হয়েছে সতীর্থদের কটূক্তি।
তাই বলে হাল ছাড়েননি। খাওয়ার অভ্যাস বদলেছেন, নিজেকে বদলেছেন। এরপর ফুটবল নামক বস্তুটা পায়ে আসতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন সবুজ গালিচায়। সেটিও যে সব সময় গালিচা ছিল তাও নয়, কাঁটাও ছিল।
৮ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব তেরালিওনের হয়ে ফুটবলের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। এরপর যান লিওঁতে। শুরুতে বলবয়ের কাজও করেছেন। মাঠে নিজেকে মেলে ধরলেও, মাঠের বাইরে অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য সমালোচিত হন।
ক্যারিয়ারের আলোর বেশিরভাগ ছড়িয়েছেন ক্লাবের হয়ে। জাতীয় দলে বেনজেমা আলোটুকু ঠিকভাবে ছড়ায়নি কিংবা ছড়াতে দেয়া হয়নি। এইসব হিসেবনিকেশকে সঙ্গী করেই অবশেষে ফ্রান্সের জার্সি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন সময়ের সেরা এই তারকা।
এতে অবশ্য খানিকটা আফসোস থাকতে পারে বেনজেমার। তবে আলোর দিকে তাকালে সব আফসোস নিমিষেই উবে যাওয়ার কথা তার। পুরস্কার হাতে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, টনি ক্রুস ও সার্জিও রামোস। একটু পেছনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে তালি দিয়ে যাচ্ছেন বেনজেমা। ছবিটার কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই।
সেই সঙ্গে বেনজেমার হাসি। হাসিরও অনেক রকম অর্থ হয়। বেনজেমার সেই হাসির আড়ালে ছিল হাহাকার। আর ছিল বিশালাকার গ্রহের আড়ালে উপগ্রহ হয়ে থাকার বেদনা। অথচ নক্ষত্রের মতো আলো বিলোনোর ক্ষমতা তাঁরও আছে। ৩৪ বসন্ত পেরিয়ে সেটা দেখিয়ে দিলেন।
রোনালদো-মদরিচদের ভিড়ে গড়পড়তা মানের একজন স্ট্রাইকারের বেশি যে বিবেচিত হতেন না বেনজেমা। কিন্তু এই ফরাসি তারকা লাগাম হাতে শাসন করেছেন সময়ের দৈত্যকে। যে বয়সে তার সমসাময়িকরা ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে, সে বেলায় এসে ‘কিং করিম’-এর পায়ে যেন উষার আলো!
গত মৌসুমে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা পার করেছেন বেনজেমা। রিয়ালকে সাফল্য এনে দেওয়া এবং নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পুরস্কারটা নিয়েছেন নিজের গুরু ও আদর্শ জিনেদিন জিদানের হাত থেকে। গর্বের ব্যাপারই তো বটে।
ফরাসিদের হয়ে কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা না জিততে পারলেও ক্লাব ফুটবলের হয়ে ভরিয়ে তুলেছেন শিরোপার ঘর। ফরাসি ক্লাব লিওর হয়ে চারটি লিগ ওয়ান, একটি লিগ কাপ ও দুটি ফ্রেঞ্চ সুপার কাপ জিতেছেন।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন চারটি লা লিগা, দুটি কোপা দেল রে, চারটি স্প্যানিশ সুপার কাপ, পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, চারটি উয়েফা সুপার কাপ ও চারটি ক্লাব বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারে ৫৩৪টি ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ২৬৭টি।
কবির সুমনের একটি গানের লাইন এমন, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।’বেনজেমাও পরাজিত হননি। হাল ছাড়েননি। বরং হতাশা ও মুষড়ে পড়া পৃথিবীর বুকেই লিখেছেন, খাঁড়া পাহাড় বেয়ে চূড়ায় ওঠার অসামান্য গল্প।
Posted ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin