
নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
‘যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অগ্রহায়ণ মাসে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাইন ফুটাতে গিয়ে তার ডান হাত উড়ে যায়। তখন তাকে অজ্ঞান অবস্থায় জিবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন তিনি জয় বাংলা বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন। আর তিনি কিছুক্ষণ পর পর বলে ওঠেন ‘আমার স্টেনগান কই।’ যুদ্ধে যেতে তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেন।
কথাগুলো বলছিলেন একাত্তরের নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা শর্মিলা দেব সরস্বতী।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার জিবি হাসপাতালে থাকাকালে এমন অনেক স্মৃতি তার মনে আছে। এখনো তার কানে বেজে উঠে ‘আমার স্টেনগান কই, আমার স্টেনগান কই’ এই বলে হুঙ্কার।
তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতাম। তখন কে ছেলে কে মেয়ে তা মনে থাকত না। তখন আমার বয়স ছিল ১৭ বছর।
শর্মিলা দেব সরস্বতী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার উত্তর ইউপির আমোদাবাদ গ্রামের মৃত ডালিম কুমার দত্তের স্ত্রী ।
আগরতলার জিবি হাসপাতালে একজন সেবিকা হিসেবে কাজ করার সুবাদে দেশের প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের এমন ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করার তার সুযোগ হয়েছিল। জিবি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার দেওয়ার জন্য আলাদা একটি ইউনিট স্থাপন করা হয়। প্রতিদিনই বাংলাদেশ থেকে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাহত হয়ে এখানে চিকিৎসা নিতে আসতেন। অনেকে চিকিৎসারত অবস্থায় মারাও গেছেন। প্রায় ১ বছর তিনি ওই হাসপাতালে ছিলেন বলে জানান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসাধীন থাকায় তাদের সেবার জন্য ওই হাসপাতালে রাখা হয়ে ছিল।
শর্মিলা দেব বলেন, ৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমরা স্বপরিবারে ভারতের আগরতলা চলে যাই। সেখানকার নারায়ণপুরে একটি ভাড়া বাসায় মা বাবা ভাই বোন নিয়ে সবাই থাকতাম। কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের রেশনের ব্যবস্থা হয়। কিছুদিন পর জানতে পারি আমাদের রেশন দেয়া হবে না। এমনকি বলা হলো আগরতলা ছেড়ে আসাম চলে যেতে হবে। এক পর্যায়ে রেশন বন্ধ হলে আমরা বিপদে পড়ে যাই। আগরতলার কয়েকজন দরদি মানুষ আমাদেরকে খাবার দিতেন। এ অবস্থায় একদিন আমি আমার ছোট বোন গীতা দেবকে আগরতলার কর্নেল চৌমুহনী এলাকার মুক্তিযোদ্ধা অফিসে যাই। সেখানে ছিলেন জিবি হাসপাতালে ডাক্তার রতিন দত্ত, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুছ মাখন ও লুৎফুল হাই সাচ্চু। তারা আমরা দুই বোনকে বলেন, তোমরা জিবি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করবে। এখান থেকে রিলিফও পাবে। তাদের কথা মতো রাজি হয়ে যাই। আমরা দুই বোন জিবি হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করলাম। প্রতিদিন ৬ টা থেকে দুপুর ১২ টা সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পযর্ন্ত কাজ করতে হতো।
তিনি বলেন, গুলি বোমা আহত হয়ে আসা মাত্র আমরা প্রথমে তাদের বরফ দিয়ে ছ্যাকা দিতাম। পরে ডাক্তার এসে চিকিৎসা করতেন। ডা. রতীন দত্ত, ডা. রঞ্জিত ও সালাম খন্দকারের স্ত্রী ছিলেন জিবি হাসপাতালের নিয়মিত চিকিৎসক। তারা আমাদের খুব উৎসাহ দিতেন। তাছাড়া আমরা এ কাজে বেশি উৎসাহ পেয়েছি ভারতের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর কাছ থেকে। তিনি বেশ কয়েকবার জিবি হাসপাতালে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নিতে।
তিনি আমাদের মাথায় হাত রেখে বলতেন, তোমাদের কোন কষ্ট হচ্ছে কি না। আমি তখন বলি আমাদের দেশের মানুষ আমাদের আপনজন এ কথা শুনে তিনি খুশি হয়েছেন। পরে তিনি হাসপাতালের সেবিকাদের নিয়ে ছবিও তোলেন।
তিনি বলেন, হাসপাতালে কাজ করে কোন টাকা পয়সা পেতাম না । এতে আমাদের কোন কষ্ট মনে হয়নি। মাঝে মধ্যে আর্মি অফিসারদের আত্মীয় স্বজনরা আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে।
শর্মিলা দেব বলেন, সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে না থাকলেও আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়নি যুদ্ধের বীভৎসতা। একদিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ৫ জন যুবতীকে অসুস্থতা অবস্থায় জিবি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওই যুবতীদের শরীরের কোনো কাপড় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গামছা, শার্ট দিয়ে কোন রকমে ঢেকে নিয়ে যায়। তাদের গাল, স্তন ও লজ্জাস্থান কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে পাকিস্তানের হানাদাররা। শরীরের অনেক স্থানের মাংস পর্যন্ত ছিল না। আখাউড়ার দূর্গাপুর এলাকার চন্ডিমোড়া পাকিস্তানী ক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্ধার করে ছিল। কিন্ত কাউকে শেষ পর্যন্ত কাউকে বাঁচনো গেল না। আজও শিউরে উঠে ওইসব কথা মনে পড়লে।
শর্মিলা দেব বলেন, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে আমাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় এ খবর শুনে বাবা মারা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর শুনে আনন্দিত হয়। আমিই ছিলাম সংসারে সবার বড়। হাসপাতালে রোগী থাকায় দেশে যেতে পারছিলাম না। মা ভাই বোনকে দেশে পাঠিয়ে দেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪ মাস পরে দেশে আসি। ছুটে যাই আব্দুল কুদ্দুস মাখনের কাছে। তিনি নগদ আমাকে ৭ হাজার টাকা দেন। ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান খানকে নির্দেশ দেন আমাদের ঘর বানানোর টিন দিতে। জমি বিক্রি করে আমাদের দুই বোনকে বিয়ে দেন মা। কিন্তু তার স্বামী স্বচ্ছল না হওয়ায় খুবই কষ্টে কাটতে হচ্ছে তাদের দিন।
তিনি আরো বলেন, প্রথম দিকে চিন্তা করেনি আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেনি। তাহলে আমরা কিসের মুক্তিযোদ্ধা এমন চিন্তা ভাবনাই ঘোরপাক খাচ্ছিল মাথায়। শেখ হাসিনার সরকার প্রথম ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দেয় যুদ্ধের সময় যারা সেবিকা হিসেবে কাজ করেছে তারাও বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নাম তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমান সরকারেরর আইনমন্ত্রীর সহায়তায় একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। সেই ঘরে এক মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। নিয়মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছি। আমার কোনো কষ্ট নেই।
Posted ৩:৫৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin