নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্র। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে বাছাই করা হয় দেশটির শীর্ষ নেতৃত্ব। দায়িত্ব গ্রহণকালে নির্বাচিত এসব নেতাকে শপথ নিতে হয় এ বলে যে, তারা দেশ ও জাতির স্বার্থে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিরতরে গোপন রাখবেন।
স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় স্বার্থ জড়িত এমন সব বিষয়ের নথি বিশেষ করে যেগুলো ‘টপ সিক্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত, সেসব নথির সুরক্ষা নিশ্চিত করা নির্বাচিত নেতাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দায়িত্ব শেষে এসব নথি নিজের কাছে রাখা বা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।
কিন্তু ইদানীং সেই অনুচিত কাজটাই যেন মহোৎসাহের সঙ্গে করছেন মার্কিন নেতারা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপন নথির অব্যবস্থাপনার বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। চলছে তুমুল আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের রাজনীতিকদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজও অংশ নিচ্ছে সে বিতর্কে।
মূলত এসব আলোচনা ও বিতর্কের শুরু গত বছরের (২০২২) আগস্ট মাসে ফ্লোরিডা রাজ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার-এ-লাগোর বাড়িতে এফবিআই গোয়েন্দাদের অভিযানের মধ্যদিয়ে।
এরপর সম্প্রতি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ব্যক্তিগত অফিস ও বাড়ি থেকে গোপন নথি উদ্ধারের পর সেই বিতর্কের পালে জোর হাওয়া লাগে, যা চলতি সপ্তাহে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের বাড়ি থেকে নথি উদ্ধারের পর নতুন মাত্রা পেয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ নথির সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেকর্ডস অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রশাসনের অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোকে টপ সিক্রেট, সিক্রেট ও কনফিডেন্সিয়াল-এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
তোলপাড় মার্কিন রাজনীতি
ফ্লোরিডা রাজ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার-এ-লাগো রিসোর্ট থেকে সরকারি গোপনীয় নথি উদ্ধার করা হয়েছিল। এতে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে বর্তমানে তদন্ত চলছে। তদন্তের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা ট্রাম্পের কাছ থেকে কমপক্ষে ৩২৫টি গোপনীয় নথি জব্দ করেছেন।
গোপন নথি অব্যস্থাপনার অভিযোগে ট্রাম্প এখন ফৌজদারি তদন্তের অধীনে রয়েছেন। এরপর আসে বাইডেনের গোপন নথি উদ্ধারের খবর। গত বছরের নভেম্বর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত চার দফায় আইনজীবীরা বাইডেনের বাড়ি ও অফিসে গোপন নথি ও সরকারি রেকর্ডের সন্ধান পান।
সবশেষ গত সপ্তাহে বাইডেনের বাড়ি থেকে অন্তত ৬টি গোপন নথি উদ্ধার হয়। এরই মধ্যে বাইডেনের নথি উদ্ধারের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। বাইডেনের গোপন নথির আলোচনা শেষ না হতেই গত সপ্তাহে মাইক পেন্সের ইন্ডিয়ানার বাড়িতে এক আইনজীবী গোপন নথি আবিষ্কার করেন। সেগুলো দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রেসিডেন্টের বাড়িতে ও ব্যক্তিগত অফিসে গোপন সরকারি নথি উদ্ধারের ঘটনায় মার্কিন রাজনীতিতে এখন রীতিমতো তোলপাড় চলছে। শীর্ষ নেতারা কেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথি গোপন করছেন – উঠছে এমন প্রশ্নও।
কোনো প্রশাসনের মেয়াদ শেষ হলে হোয়াইট হাউসের এসব রেকর্ড ও নথি জাতীয় আর্কাইভসে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় রাখার কথা। যেগুলো জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। অথচ দফায় দফায় এসব নথি পাওয়া গেছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্টের বাড়িতে। এ নিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
একের পর এক গোপন নথি উদ্ধারে চরম সমালোচনার মুখে পড়ছেন এর সঙ্গে জড়িতরা। তাদের দায়িত্বজ্ঞান ও কোনো গোপন আঁতাত নিয়ে কথা বলতেও ছাড়ছেন না সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা। এমনকি নথি উদ্ধারের ঘটনায়, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিদায় ঘণ্টা বাজছে কিনা-সেই প্রশ্নও উঠছে।
বাইডেনের বিদায় ঘণ্টা কি বাজছে?
গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত মোট তিন দফায় বাইডেনের বাড়ি ও ব্যক্তিগত কার্যালয় থেকে গোপন নথি উদ্ধার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। প্রথম নথি উদ্ধারের ঘটনা ঘটে ওয়াশিংটনে বাইডেনের সাবেক ব্যক্তিগত কার্যালয় থেকে। এরপর ডেলাওয়ার রাজ্যে তার একটি বাড়িতে আরও কিছু নথির সন্ধান পাওয়া যায়। সবশেষ গত শনিবার (২১ জানুয়ারি) একই বাড়ি থেকে আবার গোপন নথি উদ্ধার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন বাইডেন। উদ্ধার হওয়া গোপন নথিগুলো সেই সময়ের। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হলে কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় দাপ্তরিক নথি ও গোপন দলিল জমা দিতে হয়। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের মেয়াদ শেষের পরও এসব নথি জমা দেয়া হয়নি।
সবশেষ গোপন নথি উদ্ধারের পর ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারাও বাইডেনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। সমালোচকদের একজন পশ্চিম ভার্জিনিয়া রাজ্যের সিনেটর জো মানচিন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে তিনি বলেছেন, গোপন নথি উদ্ধারের বিষয়ে বাইডেনের অনুশোচনা থাকা উচিত। এর জন্য বাইডেনই দোষী—এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
নথিগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আরেক ডেমোক্র্যাট নেতা ডিক ডারবিন। ইলিনয় রাজ্যের এ সিনেটর বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন। এমনটা যখন কোনো কংগ্রেস সদস্যের সঙ্গে ঘটে, আর গোপন নথির ব্যাপারও জড়িয়ে থাকে, তখন বিষয়টি সামলানোর জন্য আমরা একটি রীতি অনুসরণ করি। এই নথিগুলো এখানে–সেখানে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে, এটা মেনে নেয়া যায় না।’
এদিকে বাইডেনের সমালোচনা করলেও অনেক ডেমোক্র্যাট নেতা আবার নথি উদ্ধারের ঘটনায় তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে ট্রাম্পের বাড়ি থেকে গোপন নথি জব্দ করার বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ট্রাম্প গোপন নথি নিয়ে যে কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছেন, বাইডেনের ঘটনা ততটা খারাপ নয়।
যেমনটা বলছেন ডিক ডারবিন। বাইডেনের সমালোচনা করলেও তিনি বলেছেন, নথি উদ্ধারের ঘটনায় জো বাইডেন পুরোপুরি সহযোগিতা করেছেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে তার একটি বড় ফারাক রয়েছে। আর ডেলাওয়ারে ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস কুনস বলেছেন, ‘আমি মনে করি না, এটা এমন কোনো ঘটনা যে মার্কিনদের সারা রাত জাগিয়ে রাখবে।’
বিষয়টি নিয়ে চলতি সপ্তাহেই সংবাদমাধ্যম এবিসির সঙ্গে কথা বলছিলেন ক্রিস কুনস। তার ভাষ্য, বাইডেনের ডেলাওয়ারের বাসা থেকে নতুন করে নথি উদ্ধারের ঘটনায় যে উদ্বেগ দেখানো হচ্ছে, তা বাড়াবাড়ি। এতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে দেশবাসীর নজর সরে যাচ্ছে।
নথি উদ্ধারের বিষয়ে বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে তফাত তুলে ধরতে গিয়ে ডেলাওয়ারের সিনেটর ক্রিস কুনস বলেন, বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ওই নথিগুলো উদ্ধার ও তদন্তের বিষয়ে তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তবে ট্রাম্পের বাড়ি থেকে যখন এমন নথি উদ্ধার করা হয়েছিল, তখন তিনি বারবার একই দাবি তুলছিলেন যে নথিগুলো কাছে রাখার অধিকার রয়েছে তার।
বর্তমান ও সাবেক এই দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যকার তফাতটা উঠে এসেছে জরিপের হিসাবেও। এবিসি নিউজে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, চলতি সপ্তাহে ৩৪ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে ওই নথিগুলো বাইডেন ঠিকঠাকভাবেই সামলে রেখেছেন।
আর ৬৪ শতাংশ মনে করেন, বাইডেন ভুল করেছেন। একই ধরনের একটি জরিপ করা হয়েছিল ট্রাম্পের বাড়ি থেকে নথি উদ্ধারের পর। সেখানে দেখা যায়, ৭৭ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন ট্রাম্প ভুল করেছেন।
এদিকে ডেমোক্র্যাট নেতারা বাইডেনকে কিছুটা ছাড় দিলেও একাট্টা বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির নেতারা। বাইডেনকে ‘গোপন নথির মজুতদার’ আখ্যা দিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান সদস্য মাইক টার্নার বলেছেন, এ ঘটনায় চলা তদন্ত দেখে মনে হচ্ছে কিছু আড়াল করার চেষ্টা চলছে।
পরিষদের আরেক রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল ম্যাককাউল বলেছেন, ‘যতক্ষণ না ওই নথিগুলো দেখছি, বলতে পারছি না সেখানে কী আছে। সেখানে শত্রুরাষ্ট্র, বিশেষ করে চীন নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত তথ্যও থাকতে পারে।’
এই ঘটনা আরও বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন এই রাজনীতিবিদ। তার ভাষায়, ‘ওয়াটারগেটও প্রথম দিকে ছোট একটি কেলেঙ্কারি ছিল। তবে পরে কিন্তু তার জেরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।’
এখন থেকে ৫১ বছর আগে ১৯৭২ সালের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ইতিহাসে বহুল আলোচিত ঘটনা। মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির ওই ঘটনায় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
Posted ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin