শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা সংকট: কমছে বৈদেশিক সহায়তা, চাপে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   রবিবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট

রোহিঙ্গা সংকট: কমছে বৈদেশিক সহায়তা, চাপে বাংলাদেশ

দিন যায় দিন আসে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢলে মিয়ানমার থেকে অন্তত সাড়ে ৭ লাখ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে সবমিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এর বাইরে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যাও কম নয়। রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালের পর কী প্রতি বছরই প্রয়োজনীয় বিদেশি সহায়তা বাংলাদেশ পেয়েছে?

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সার্বিক সহায়তা দিতে প্রতি বছর বিপুল অর্থের প্রয়োজন। আশ্রয় শিবিরগুলোর মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যও প্রয়োজন বিপুল অর্থের। অথচ, বছর বছরই বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ কমছে, যা বাংলাদেশি নীতি নির্ধারকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

বাংলাদেশ সরকার ছাড়া রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আসত মূলত বিভিন্ন দাতা দেশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশ ও সংগঠনের মাধ্যমে এই সহায়তা দেয়া হতো। এই প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার ইউএনএইচসিআর।

 

দাতা সম্মেলনে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তার আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এর আগে, রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন নিয়ে মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ বা জেআরপি কমিটি। এই কমিটির পরিকল্পনা অনুসারেই প্রতিবছর জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন এনজিও কাজ করে থাকে। তবে বিদেশি সহায়তা থাকার পরও এরই মধ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশকে ১২১ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকারও বেশি) গচ্চা দিতে হচ্ছে কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য।

জেআরপি ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে আসছে। সেই সময় থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জেআরপি বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে ২৪৩ কোটি ডলার ত্রাণ সহায়তা সংগ্রহ করেছে। কিন্ত তারপরও বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন পূরণে। এক্ষেত্রে শুরু থেকে বিদেশি তৎপরতাও পর্যাপ্ত ছিল না।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজন ছিল ৪৩৪ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। বিপরীতে বিদেশি সহায়তা ছিল ৩১৭ মিলিয়ন। কম ছিল মোট চাহিদার ২৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজনের বিপরীতে সহায়তা ছিল ৬৫৫ মিলিয়ন। ঘাটতি ছিল ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালে প্রয়োজনীয় ৯২০ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে সহায়তা ছিল ৬৯৯ মিলিয়ন, ঘাটতি ছিল ২৪ শতাংশ। ২০২০ সালে বৈদেশিক সহায়তায় ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৪০ শতাংশ। সে বছর প্রয়োজন ছিল ১০৫৮ মিলিয়ন ডলার। বিপরীতে সহায়তা ছিল মাত্র ৬২৯ মিলিয়ন ডলার।

 

২০২১ সালে ঘাটতি কমে আসে। তারপরও সে বছর ঘাটতি ছিল ২৮ দশমিক ১ শতাংশ। সে বছর ৯৪৩ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজনের বিপরীতে বিদেশি সহায়তা ছিল ৬৭৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে প্রয়োজনের বিপরীতে প্রাপ্তির ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যায়। ২০২২ সালে প্রয়োজনীয় সহায়তার অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশকে বহন করতে হয়। সে বছর ৮৮১ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে বিদেশি তহবিল ছিল মাত্র ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার।

ওপরের উপাত্ত থেকে স্পষ্ট যে, ২০২০ সালের পর থেকে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ক্রমেই কমেছে। এর সহজ অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, যা বাংলাদেশের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে অর্থ সহায়তা কমে যাওয়ার অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ইস্যু বা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আর ততটা আগ্রহী থাকছে না।

 

রোহিঙ্গা সংকটের মতো বিশ্বের নানা প্রান্তে একাধিক মানবিক সংকট চলছে। যার ফলাফল হিসেবে জাতিসংঘ আফগানিস্তান, বুরকিনা ফাসো এবং বুরুন্ডির মতো দেশে জেআরপি গঠন করেছে। এর বাইরেও একাধিক মানবিক রেসপন্স কমিটি গঠন করেছে সেসব সংকটে অর্থায়ন করার জন্য। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গা সংকট অব্যাহত। ফলে আগামী বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সাহায্য কমতে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর তহবিল ঘাটতির প্রভাব উপলব্ধি করতে পারাটা খুবই প্রাসঙ্গিক।

আর্থিক ক্ষতি

খোলা চোখেই দেখা যায়, ক্রমবর্ধমান হারে সহায়তা কমতে থাকলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে। সরাসরি আর্থিক ক্ষতি তো রয়েছেই, এর বাইরেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণরে জন্য বিপুল পরিমাণ জনশক্তি নিয়োজিত রাখতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে কেবল রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিতেই ব্যয় করেছে ১০০ কোটি টাকা। প্রায় ৩৮১ মিলিয়ন টাকা খরচ করেছে ভাষানচর আশ্রয়ন প্রকল্প নির্মাণে। যেখানে মোট রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের এক দশমাংশকে স্থানান্তর করার কথা।

 

করোনা মহামারির পর বিশ্বের দাতা দেশ এবং সংস্থাগুলো আগের মতো সহায়তা দিতে সক্ষম নয়। এছাড়া, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও মানবিক সংকট চলমান থাকায় সেখানেও অর্থায়ন করতে হচ্ছে। শঙ্কার বিষয় হলো, আগামী দিনে এসব সংকট আরও বাড়তে পারে। যার ফলে রোহিঙ্গা সংকট আরও গুরুত্ব হারাবে। পরিণতিতে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।

বাড়ছে অপরাধ

যথাযথ নজরদারির অভাবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ বাড়ছে। তারা মানবপাচার, চরমপন্থা, মাদক পাচার, সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। তৈরি করছে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ ইয়াবা প্রবেশ করে মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে। আশঙ্কার বিষয় হলো, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার পর প্রাথমিকভাবে এসব ইয়াবার চালানের ৭০ শতাংশই মজুত করা হয় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে। এরপর সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে।

রোহিঙ্গা শিবিরে অপহরণ প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। ক্যাম্পের ভেতরে ক্ষমতার বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মারামারি, খুনোখুনিও হয়েছে বেশ কয়েকবার। সাম্প্রতিক সময়ে এমন অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার একটি বড় উদাহরণ হতে পারে প্রত্যাবাসনকামী রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ মাস্টার হত্যা।

 

বাংলাদেশ পুলিশ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে অপরাধ প্রবণতা কমাতে ‘অপারেশন রুট আউট’ শুরু করেছে। ২০২২ সালে জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে অন্তত ২০ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই ছিলেন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতা। প্রতিবেদন অনুসারে, সম্প্রতি বিভিন্ন অপরাধের কারণে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির থেকে অন্তত ৯০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আর্থিক সংকটের কারণে রোহিঙ্গারা প্রায়ই শিবির ছেড়ে বের হয়ে আসছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে কাঠের তৈরি নৌকায় করে। সম্প্রতি এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ২০২১ সালে যেখানে মাত্র ৫০০ রোহিঙ্গা সমুদ্র পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছিল, ২০২২ সালে সেই সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার ৪০০ জন।

আশ্রয়দাতা ও রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনমন

সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশ সাধ্যমতো রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অস্বস্তি এবং অভিযোগ বাড়ছে। বন্যার পানির মতো কয়েক দিনের মধ্যে কক্সবাজারের উখিয়ায় প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের প্রবেশ স্থানীয়দের স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত করে তুলেছিল। সে জায়গা থেকে সময় যাওয়ার সঙ্গে স্থানীয়দের মনোভাব রোহিঙ্গাদের প্রতিকূলে চলে গেছে।

 

পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা ও বিপুল তহবিল ঘাটতি স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। অনেক চেষ্টা করা হলেও কবে নাগাদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে তা কেউই জানে না। উপরন্তু, দেশটিতে ২০২১ সালে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান সংকট সমাধান কঠিন করে তুলেছে।

পরিবেশগত প্রভাব

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে, কক্সবাজারের সাড়ে ৩ হাজার একর বনভূমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যা কক্সবাজারের মোট বনাঞ্চলের ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর বাইরেও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের জ্বালানির চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ গাছ কাটতে হচ্ছে, যা স্থানীয় জীব-বৈচিত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নিয়মিত ভূমিধসের ঘটনা ঘটছে, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এ অবস্থায় যদি তহবিল সংকটে পড়তে হয় তবে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আরও খারাপের দিকে যাওয়ার শঙ্কাই বেশি।

বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। দেশের অনেক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। তাই বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল না পায় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে না যাওয়ার পর্যন্ত বৈদেশিক তহবিল বাংলাদেশের জন্য অতি জরুরি।

(মডার্ন পলিসি থেকে অনূদিত)

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]