শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিএমডিসির নম্বর চাইতেই পালালো ভুয়া ডাক্তার!

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ০১ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট

বিএমডিসির নম্বর চাইতেই পালালো ভুয়া ডাক্তার!

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাকের ডগায় বসে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে চেম্বার খুলে চিকিৎসা শুরু করে নয়ন কুমার চাকি নামের এক ভুয়া ডাক্তার।

নয়ন কুমার চাকি কালীগঞ্জ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বালীগাঁও এলাকায় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রোগী দেখার কাজ করদেন।

সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস.এম মন্জুর-এ-এলাহী ওই ভুয়া ডাক্তার চাকির খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এমন প্রতারণার খবর।

জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রোগী দেখার কাজ করতেন তিনি। এর মধ্যে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের ভিড়ও থাকতো বেশ। বিষয়টি দেখে সন্দেহ হয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস.এম মন্জুর-এ-এলাহীর। পরে তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়ন কুমার চাকির চেম্বারে যান। তার সঙ্গে গল্প করার এক পর্যায়ে চাকি কোন মেডিকেল থেকে পাশ করেছেন জানতে চাইতেই চাকি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের কথা বলেন। কোন বছর? ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজ কাউন্সিল (বিএমডিসি) নম্বর কত? জানতে চাইতেই গড়িমসি শুরু করেন।

এক পর্যায় চাকি বলেন, বিএমডিসি নম্বরটা মনে নেই। কিন্তু কাগজপত্র আছে। তার বউ বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে গেছে দুপুরে আসলেই তিনি কাগজপত্র নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবেন।

দুপুরে নয়ন চাকি ফোন দিয়ে জানান, তিনি কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছেন না, পেলেই নিয়ে চলে আসবেন। কিন্তু পরদিন জানা গেলো তিনি রাতের আঁধারে ট্রাকে মালামাল ভর্তি করে পালিয়েছেন।

চিকিৎসকরা জানান, কালীগঞ্জ উপজেলা সড়কের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিজস্ব চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখতেন কথিত ডাক্তার নয়ন কুমার চাকি। চিকিৎসার যে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হতো তাতে বা তার ভিজিটিং কার্ডে তিনি নিজেকে মেডিসিন, ডায়াবেটিস, মা ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সোনোলজিস্ট বিষয়ের চিকিৎসক বলে পরিচয় দিতেন। আর তার ডিগ্রির ঘরে লেখা আছে এমবিবিএস, এমসিএইচ (ঢাকা), সিসিডি (বারডেম), সিএমইউ (ঢাকা)।

রোগী দেখার সময় লেখা আছে প্রতিদিন ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। সিরিয়ালের জন্য একটি নম্বরও দেওয়া আছে তাতে। প্রথম দফায় ৩০০ টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ২০০ টাকা ভিজিট নেন। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মৌখিকভাবে কারো কাছে রাজশাহী মেডিকেল আবার কারো কাছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পরিচয় দিতেন বলে তারা জানান।

নাম প্রকাশে এক নারী রোগী বলেন, আমি ডাক্তার নয়ন কুমার চাকিকে দেখাবো বলে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ফোন দেই সিরিয়ালের জন্য। কিন্তু তিনি ওইপ্রান্ত থেকে জানান, তিনি আর কালীগঞ্জে নেই। এখন থেকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে বসবেন। তবে জানতে চাইলে অনলাইলে চিকিৎসা নিতে পারবো। আর এজন্য বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে বলে জানান নয়ণ কুমার চাকি।

নাম প্রকাশে বালীগাঁও এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, নয়ন কুমার চাকি দীর্ঘ দিন কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অতি কাছে প্রতারণার মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে আসছিল। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনেকে একের পর এক চাকরি করে গেলেও কেউ এই ভুয়া ডাক্তারকে সনাক্ত করতে পারিনি। তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালে রোগীদের নিয়মিত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার জন্য পাঠানোর পাশাপাশি নিজেকে সোনোলজিস্ট হিসেবে আল্ট্রা করাতেন। আর নয়ন কুমার চাকি দীর্ঘ এই সময় প্রতারণার মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকের ডাক্তার, রাজনৈতিক নেতা, কথিত সাংবাদিকসহ অনেককেই সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন বলেও জানান তারা।

সরেজমিন কালীগঞ্জ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বালীগাঁও এলাকায় নয়ন কুমার চাকির চেম্বারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তালা ঝুলছে। তাছাড়া চেম্বারের সামনে তার সকল প্রকার বিলবোর্ড, সাইন বোর্ড ও নেমপ্লেট খুলে ফেলেছে। সেখানে এখনো কিছু রোগী এসে তালা দেওয়া দেখে তার ব্যবহৃত মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। তবে স্থানীয়দের কাছে নয়ন কুমার চাকির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেই তারা জানাচ্ছে চাকি পালিয়েছে। স্থানীয়দের প্রশ্ন কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও উপজেলা পরিষদের নাকের ডগায় কিভাবে দীর্ঘদিন সাধারণ রোগীদের প্রতারণার মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে আসছিল ভুয়া ডাক্তার নয়ন কুমার চাকি।

নয়ন কুমার চাকির চেম্বারের বাড়ির মালিক মনির উদ্দিন পাঠান মিঠু জানান, তার বাসায় নয়ন কুমার চাকি ৮-৯ বছর ভাড়া ছিল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ফোনে জানায় ঢাকার পিজি হাসপাতালে তার ট্রেনিং থাকায় তিনি একবারে চলে গেছেন।

বাড়ির মালিক আরো জানান, তিনি এলাকায় থাকেন না, পরে এলাকায় এসে শুনতে পান, চাকি এতদিন ডাক্তারি করেছেন তবে তার কোনো কাগজপত্রই নেই। প্রতি মাসে অগ্রিম হিসেবে ভাড়া নিয়ে নেয়ায় তার কোনো বাড়ি ভাড়া বাকী ছিলনা বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে নয়ন কুমার চাকির ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল দিলে তিনি জানান, বাড়ি ভাড়ার মেয়াদ শেষ তাই তিনি চলে গেছেন। তার ডাক্তারি করার মত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আছে। বিএমডিসি নম্বর জানতে চাইলে তিনি বলেন নম্বর আছে, তবে দেওয়া যাবে না বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে একাধিকবার ফোন দিয়ে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস.এম মন্জুর-এ-এলাহী বলেন, ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবরে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করি। যোগদানের পর থেকেই স্থানীয় এমপির পরামর্শে স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবায় কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি। হাসপাতাল ও কমিউনিটি হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় নামধারি ডাক্তার বা কাগজপত্র বিহীন ক্লিনিকগুলোতে অভিযান অব্যাহত রাখি। এরই ধারাবাহিকতায় ভুয়া ডাক্তার নয়ন কুমার চাকির চেম্বারে অভিযান চালাই। কিন্তু তাকে সময় দিয়ে কাগজপত্র চাইতেই তিনি রাতের আঁধারে পালিয়ে যান।

তিনি আরো বলেন, এরই মধ্যে জারিফ মেডিসিন কর্নানের স্বত্বাধিকারী মো. শোয়েব, নূরজাহান হাড় ভাঙ্গা চিকিৎসালয়ের স্বত্বাধিকারী মো. সেলিম জাহান ও আবেশমনি স্বত্বাধিকারী খাইরুল বাশার খোকন চেম্বার খুলে বিএমডিসি নম্বর ছাড়া নামের পাশে ডাক্তার শব্দ ব্যবহার করে দীর্ঘদিন যাবৎ স্থানীয় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। এছাড়াও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১শ গজের মধ্যে নিউ পপুলার নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসা সেবার খবর পেয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ধরণের কাজ আর করবে না মর্মে তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে উল্লেখিত ব্যক্তিদের এই ধরণের কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০১ মার্চ ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]