শুক্রবার ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাকে অসম্মান করে নয়

অধ্যাপক ড. এম শাহ্‌ নওয়াজ আলি:   |   শনিবার, ০৪ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট

বাংলাকে অসম্মান করে নয়

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বরকত, সালাম, রফিকসহ আরও অনেকে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন মাতৃভাষার মর্যাদা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই চেতনা আজ ক্ষয়িষ্ণু। আমরা শুধু ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ এলে অনেকটা দায়িত্ববোধ ও লোকলজ্জার কারণে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে যাই শহীদ মিনারে। এই একটি দিনের যাওয়াটাও নিজের বা নিজেদের দলের প্রচারণা বাড়ানোর জন্য। কোন দলের পুষ্পস্তবক কত বড়, ব্যানার কত বড়, দলের লোকসংখ্যা কত ইত্যাদির প্রতিযোগিতায় ভাষা আন্দোলনের চেতনা মুখ লুকিয়ে বাঁচে।

পরিতাপের বিষয়, শিক্ষিত সমাজের একটা বিরাট অংশের অনীহা দেখা যায় বাংলা ভাষার প্রতি। তাঁরা বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই মানসিকতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলে বিশ্বের দরবারে বাংলাকে কখনোই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না। এর মানে এই নয়, আমি বাংলাদেশে ইংরেজি চর্চার বিরোধিতা করছি। ইংরেজিসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার চর্চা এখানে করা দরকার, তবে বাংলাকে অসম্মান করে নয়।

বিশ্বে প্রতিটি জাতিই তার মাতৃভাষার ভিত আগে শক্ত করে, তারপর যোগাযোগ স্থাপনের জন্য অন্য ভাষা আয়ত্ত করে। এতে নিজের ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার তুলনা করাও সহজ হয়। এভাবে তুলনামূলক বিবেচনায় অন্য ভাষার উৎকৃষ্ট শব্দ বা সেই জাতির উৎকৃষ্ট আচরণ নিজেদের মতো করে মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাঙালিরা যখন বাংলাকে অবহেলা করে, উদাসীনতা দেখায়, তখনই আঘাত লাগে প্রাণে। নিজের নাক কেটে পরের শোভা বৃদ্ধি করা বোকামি ছাড়া আর কিছু কি? মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম যথার্থ বলেছিলেন– যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

ভাষা আন্দোলনের সময় যাঁরা মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে এক অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আজও অনেকে বেঁচে আছেন। তাঁদের খোঁজখবর নেওয়ার মতো মানসিকতাও হারিয়ে ফেলেছি আমরা। ভাষার জন্য তাঁদের আত্মত্যাগ কখনোই ভোলার নয়। ভাষাসংগ্রামীদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাঁদের ও পরিবারগুলোর খোঁজ রাখা প্রয়োজন। ৭০ বছর পার হওয়ার পরও ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা হয়নি; হাইকোর্টের এ বিষয়ে নির্দেশ থাকলেও। তবে মনে রাখতে হবে, তালিকা তৈরি করতে গিয়ে যেন ভুল কোনো কিছু না হয়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মতো ভুয়া ভাষাসংগ্রামী করা ঠিক হবে না।

তবে সংশয়, বিস্ময় বা দ্বিধা নয়; প্রাণের অনুভূতি ও মমত্ববোধ দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত ভাষার মর্যাদা এনে দেওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে বাঙালিকে। এটা স্বস্তির যে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ছে। মাতৃভাষার জন্য লড়াই করে, জীবন দিয়ে বিশ্বে যে বিরল ইতিহাস বাঙালি তৈরি করেছে, তার স্বীকৃতি আমাদের জন্য গৌরবের। কিন্তু সেই গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বত্র বাংলার প্রচলন জরুরি। বাংলা ভাষার সঙ্গে মা-মাটি-মানুষ তথা দেশমাতৃকার প্রেমও প্রয়োজন। একাত্তরের স্বাধীনতার ইতিহাসও আমাদের প্রেরণা জোগায়, যদিও বৈরী বাতাস বইছে আজ ৭১-এর চেতনার আকাশে। দীর্ঘ ৯টি মাস কতখানি আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা একটি মানচিত্র অর্জন করেছি, তা সবাই জানি। কেন সেই আত্মত্যাগ? তার সবটুকু সবাই না জানলেও অন্তত এইটুকু সবাই জানি– একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়াই ছিল আমাদের লক্ষ্য।

উত্তরণের পথ একটাই– বাঙালিকে আবার ‘৫২’ কিংবা ‘৭১’-এর মতো নিজেদের মুক্তির অন্বেষায় সংগঠিত হতে হবে। আবার বাঙালিকে আসাদ হতে হবে; মোস্তফা কামালের মতো সাহসী হতে হবে। আবার নূর হোসেনের মতো রাজপথে নেমে আসতে হবে। বায়ান্নকে এই চেতনার উৎস ভেবে অস্থিমজ্জায় ধারণ করতে পারলেই বাঙালির বোধোদয় হবে। আর তখনই মুক্তি সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক ড. এম শাহ্‌ নওয়াজ আলি: সাবেক সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৪:১৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৪ মার্চ ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিজয়ের ছড়া
(215 বার পঠিত)
advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]