নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ০৮ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট
জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে থেমে যেতে পারতেন। তিনি হাল না ধরলে হয়তো থেমে যেত তার সন্তানদের পড়ালেখা। তবে তিনি প্রমাণ করেছেন, অভাব অনটনে শুধু চোখের জল না ঝরিয়ে উত্তরণের চেষ্টা থাকা দরকার। আমাদের ইচ্ছাশক্তিই পারে অভাবের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাতে। এমন গল্পের জীবন্ত প্রমাণ শাহিদা। যিনি সন্তানদের নিয়তিকে বদলে দিয়েছেন কর্মময় ইচ্ছাশক্তির কাছে। বলছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) চা বিক্রেতা শাহিদা আক্তারের কথা।
ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করে সুশিক্ষিত হবে। সংসারের হাল ধরবে। মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে। এমনই প্রত্যাশা তার। কিন্তু, সংসারের টানাপোড়নের মধ্যে পড়ালেখার খরচ চালানো দুঃসাধ্য। স্বামী রিকশা চালিয়ে যা পায়, তা দিয়ে ডাল-ভাত চলে। কিন্তু, তা দিয়ে পড়ালেখার খরচ চালানো একেবারেই অসম্ভব। অর্থাভাবে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, তাই নিজেই ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন। এতে যা আয় হয়, তা দিয়ে খরচ চালান সন্তানদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাত প্রায় ৮টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের সামনে জোহা চত্বরের পূর্ব কোণে বসে আছেন এক মাঝ বয়সী নারী। সামনে রাখা একটি চায়ের ফ্লাক্স। আর সামনেই সাজানো রয়েছে কয়েকটি চায়ের কাপ। কাপগুলো বালতিতে রাখা পানিতে ধুয়ে চা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। আর চত্বরের রেলিংয়ে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সেই নারীই শাহিদা আক্তার।
শাহিদার বাড়ি রাজশাহী নগরীর ক্যাম্পাস সংলগ্ন আমজাদের মোড় এলাকায়। এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার। স্বামী পেশায় রিকশা চালক। ছেলে রাজশাহী কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র। ছোট মেয়ে ইসলামী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর বাকি দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
শাহিদা আক্তারের চায়ের ভক্ত ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, আনটি বাড়ি থেকে চা তৈরি করে নিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্রি করেন। ক্যাম্পাসের চায়ের দোকানের যেসব চা বিক্রি হয়, তার তুলনায় আনটি তৈরি চা অনেক ভালো।
চা বিক্রেতা শাহিদা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান তার জীবনযাত্রার গল্প। বলেন, প্রায় এক বছর ধরে ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করি। এখান থেকে যা পাই, তাই দিয়ে ঔষধপত্র, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা খরচে ব্যয় করি। বই কেনা, ফরম ফিলাপ, আনুষঙ্গিক সব ব্যয় এই চা বিক্রির টাকা থেকে করা হয়।
শাহিদা জানান, তার স্বামী একজন রিকশা চালক। রিকশা চালিয়ে যে টাকা প্রতিদিন পান তা দিয়ে সংসার চলে যায়। কিন্তু, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো সম্ভব নয়। তাইতো সংসারে হাল ধরতে নিজেই চা বিক্রি করেন।
শাহিদা আক্তার বলেন, বয়স হয়েছে এখন আর আগের মতো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতে পারি না। তাই এখানে (জোহা চত্বরে) প্রতিদিন বসি। মাঝেমাঝে গার্ডরা এসে তুলে দেয়, বকাঝকা করে। তাদের অভিযোগ, আমার কারণে ক্যাম্পাস অপরিষ্কার হয়। আমি বাড়ি থেকে চা বানিয়ে নিয়ে আনি ফ্লাক্সে করে। আর আমি যেখানে বসি, চলে যাওয়ার সময় তার আশপাশ পরিষ্কার করে দিয়ে যাই।
তিনি আরো বলেন, প্রতি কাপ চা সাত টাকায় বিক্রি করি। প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা বিক্রি হয়। কোনো দিন এরচেয়ে বেশি হয়, আবার কোনোদিন কমও হয়। এখান থেকে যা বিক্রি হয় তাই দিয়ে ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাই।
তিনি আরো বলেন, বিকেল ৫টার দিকে ক্যাম্পাসে আসি। রাত ৯টা পর্যন্ত চা বিক্রি করি। এরপর বাড়ি চলে যাই। রাতের খাবার দুপুরেই রান্না করে ফেলি। রাতে গিয়ে আর রান্না করতে ইচ্ছা হয় না।
শাহিদা আক্তার আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করি। তারা একদিন পড়ালেখা শেষ করে মানুষের মতো মানুষ হবে। সংসারের হাল ধরবে।
শাহিদা বেঁচে আছেন। হয়তো প্রতিদিন এ সমাজকে শিক্ষা দিতেই তিনি আজও বেঁচে আছেন। তিনি এ সমাজকে শিক্ষা দিয়ে চলেছেন, ‘নারীরা শুধুই মা নয়, তারা প্রত্যেকেই একজন যোদ্ধা।’
Posted ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৮ মার্চ ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin