বুধবার ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‌‌‘বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি বেঁচে আছি‌’

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট

‌‌‘বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি বেঁচে আছি‌’

রাজধানীর গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২১ জনে দাঁড়িয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢামেক ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিসাধীন আরো অনেকে। এ ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন তাদের ও প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে সেই বিকেল বিভীষিকাময়, ভয়ঙ্কর ও হৃদয় বিদারক বিকেল।

‘ক্যাফে কুইন’ ভবনের ১০ গজ দূরে ফুটপাতে নিজের ভ্যানে বসে ছিলেন জয়নাল আবেদীন। আচকা ভয়ংকর শব্দে বিস্ফোরণ। তাতে কানে তালা পড়ে তার। ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকা। মুড়িমুড়কির মতো উড়ে এসে রাস্তায় পড়তে থাকে ইট, ভাঙা কাচের টুকরা। তার বাঁ হাতেও এসে লাগে কাচের একটি টুকরা। শিরা কেটে মুহূর্তেই ফিনকি দিয়ে বের হয় রক্ত। ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। অনেক অসহায় মানুষ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকেন রাস্তায়। চারপাশে বাঁচার চেষ্টা, বাঁচানোর মিনতি। গুলিস্তান সিদ্দিকবাজারে মঙ্গলবারের সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন জয়নাল।

গতকাল বুধবার সকালে ঘটনাস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে যখন জয়নালের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো তার দুই চোখের আঙিনায় আতঙ্কের ছাপ। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, যানজটের কারণে রাস্তায় সব গাড়ি স্থির। হঠাৎ এলাকাটা বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের ক্ষতস্থান চেপে দৌড়ে একটু দূরে চলে যাই। ক্ষতস্থানে লাগে দুটি সেলাই। অনেক মানুষ রক্তাক্ত; চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও প্রথমদিকে সহায়তার হাত বাড়ানোর মতো কেউ ছিল না। যেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এলাম। বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি বেঁচে আছি!

সিদ্দিকবাজারের ১৮০/১ নম্বর ভবনটিতে বিস্ফোরণের সময় দুই পাশের দুটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতটাই শক্তিশালী বিস্ফোরণ যে ভবনের ইট, কাচ ও দোকানের পণ্য সড়কের উল্টো পাশে ছিটকে আসে। ভবনের সামনের সড়কের বিপরীত পাশে থাকা সরদার ট্রান্সপোর্টের দুই কর্মচারী ছিটকে আসা ইট ও কাচে আহত হন। তারা হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের একজন শাহাদাত। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে ফ্যান নামাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দের সঙ্গে ঝড়ের মতো গরম বাতাস এবং কী যেন শরীরে এসে ধাক্কা খেল। পরে তাকিয়ে দেখি, কাচে ডান পা কেটে রক্ত বের হচ্ছে। বাঁ হাত ফুলে গেছে। মানুষের চিৎকার– বাঁচাও বাঁচাও।

‌‘আমার সামনেই এক ভ্যানচালক পড়ে গেল রাস্তায়। মাথা দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছিল রক্ত। এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি আমি।’

ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির আরেক কর্মচারী ইছাবুল মোল্লাও গাড়ি থেকে ফ্যান নামাচ্ছিলেন। ইট ও কাচের টুকরা উড়ে এসে তার বাঁ হাত, পিঠ ও পায়ে আঘাত করে। আতঙ্কে দৌড় দিতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে চেতনা হারান। বললেন, ‘পড়ে যাওয়ার পর আমার কিছু মনে নেই। পরে দেখি, আমি হাসপাতালে।’

বিস্ফোরণের পর ঐ ভবনে আটকে পড়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একজন নুরুল আমিন খান। যে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটির তৃতীয় তলার সুজতী এন্টারপ্রাইজ নামে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক তিনি। ঘটনার সময় তিনিসহ আট কর্মকর্তা-কমর্চারী প্রতিষ্ঠানে ছিলেন। তিনি জানান, শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবনটি কেঁপে ওঠে। আতঙ্কিত আটজনই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। তবে নিচে লন্ডভন্ড হওয়ায় নামতে পারেননি। পরে ভবনটির ছাদ হয়ে পাশের ভবনে চলে যান। নুরুল আমিন বলেন, ভবনটি যেভাবে কেঁপে উঠেছিল, মনে হয়েছে– ভেঙে মাথার ওপর পড়বে। যখন নিচে গিয়ে নামতে পারলাম না তখন মনে হয়েছে, আর বাঁচব না। সবার মধ্যে বাঁচার আকুতি। ছাদে উঠে পাশের ভবন দিয়ে নামার পরও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিরে এসেছি।

উড়ে আসা ইটের আঘাতে সামান্য আহত হন চা দোকানি নজরুল। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রক্তের মধ্যে পড়ে ছিল মানুষ। আমরা কয়েকজন মিলে ৭-৮ জনকে রক্তাক্ত অবস্থায় গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি। তাদের কারও হাত, আবার কারও পা ঝুলছে। একজনের কোমরের নিচের অংশ ঝুলছিল। তখনো বেঁচে ছিলেন সেই ব্যক্তি। বীভৎস সেই দৃশ্য।

পল্লব চক্রবর্তী ঘটনাস্থলের পাশের সরু গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় বিস্ফোরণে ভারী একটি বস্তু তার বাঁ পায়ে এসে পড়ে। এতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চেতনা হারান তিনি। জানালেন, জ্ঞান ফিরে দেখেন, তিনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। বাঁ পা ভেঙে গেছে। বললেন, ঐ শব্দের কথা এখনো ভুলতে পারছি না। মনে হলেই শরীর কাঁপছে।

বিধ্বস্ত ভবনসংলগ্ন সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস। ঘটনার সময় সেখানে সাইফুল ইসলামসহ চার কর্মচারী ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সাইফুল বলেন, বিস্ফোরণে কাচ ভেঙে শরীরে পড়ে। কাচ সরিয়ে নিজেই বের হই। তখন রক্ত ঝরছিল প্রচুর। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৪০-৪২টি সেলাই দিতে হয়েছে।

এদিকে, মঙ্গলবার বিকেলে বিস্ফোরণের পর থেকেই ওই এলাকার অন্তত ২০ ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বিদ্যুৎ না থাকায় পানিও মিলছে না। একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে বিদ্যুৎ-পানি না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।

ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশের গ্রিন সুপারমার্কেটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনার পর থেকে মার্কেটটিতে বিদ্যুৎ নেই। একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির কর্মচারী আমজাদ জানান, ঘটনার সময় তিনি দোকানে বসে ছিলেন। বিকট শব্দে তার কানে সমস্যা হয়েছে। এখনো এক কানে ঠিকমতো শুনতে পারছেন না। বিধ্বস্ত ভবনের উত্তর পাশের একটি ভবনের কাইয়ুম সুজ নামে জুতার দোকানের কর্মচারী তুহিন জানান, তিনতলায় জুতার গুদামে কাজ করছিলেন তিনি। আতঙ্কে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। বলেন, ‘ঘুটঘুটে অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পড়ে যাই। উঠতে গিয়ে দেখি, পায়ে ব্যথা; তুলতে পারছি না। পরে উপলব্ধি করি, পা ভেঙে গেছে। ঐ অবস্থায় মৃত্যুর ভয়ে কষ্ট করে বেরিয়ে আসি।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৩:৩৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]