নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা (বীর প্রতীক) মো. আবু সালেক। তিনি বাংলাদেশের খেতাবপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউপির হাশিমপুর (ভাটামাথা) গ্রামের মৃত হাশেম মিয়ার ছেলে তিনি। তারা ৮ ভাই ১ বোন, যার মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ।
বীর প্রতীক আবু সালেক জানান, ১৯৭১ সালে তিনি কসবা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ওই বয়সেই কসবায় লজিং থেকে তিনি পড়াশোনা করতেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ওই সময়ে তিনি চারদিকে শুধু আন্দোলন সংগ্রাম আর যুদ্ধের কথা শুনতেন। সবার মুখে এসব কথা শুনে যুদ্ধে যেতে তিনি খুবই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। মানুষ যখন এ বিষয় নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করতো তখন তিনি সেই মিটিংয়ে যোগদান করতেন।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে তিনি এক প্রকার অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেন। মা, মাটি ও দেশকে কিভাবে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় এমন চিন্তা ছিল তার সারাক্ষণ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি স্কুল থেকে বাড়িতে ছুটে আসেন। তার চাচা হামিদুল হক তাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। চাচা বলতো যুদ্ধ অংশগ্রহণ করতে হলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের ভারতে যেতে হবে। ওই সময় ভারতে যাওয়ার মতো তার কাছে কোনো টাকা ছিলনা।
আবু সালেক বলেন, বাবা-মায়ের কাছে বললে বয়সের চিন্তা করে তারা আমাকে যুদ্ধে যেতে মানা করবেন। তাই বই খাতা ফেলে কাউকে না বলে চাচা, তিনি ও আরো দুইজন বন্ধু মিলে রাতের আঁধারে উপজেলার মনিয়ন্দ সীমান্ত দিয়ে আগরতলায় চলে যাই। টাকা না থাকায় আসার সময় বাড়ি থেকে ২০ কেজি ধান চুরি করে নিয়ে আসি। পায়ে হেঁটে রওনা হন কংগ্রেস ভবনের উদ্দেশে। কংগ্রেস ভবনের কাছে গিয়ে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশে ধানগুলো ভাঙ্গান। ওই চাল বিক্রি করে আমরা কিছু খাবার খাই। এরপর কংগ্রেস ভবনে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে লোক বাছাই নিয়োগ চলছে। আমি যদ্ধে যাওয়ার জন্য বললে বয়সে ছোট হওয়াতে তারা কেউ-ই আমাকে যুদ্ধে নিতে চাইলো না। বাছাইয়ে না টিকায় আমি এক প্রকার কান্না শুরু করি। আমার এই কান্না দেখে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজনরা যুদ্ধে অংশ নিতে সুযোগ দেন।
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণে নিয়োগ পেয়ে সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে ওমপি নগরে পাঠানো হয়। সেখানে একটানা ২১ দিন প্রশিক্ষণ শেষে মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টরে পাঠানো হয়। সেখানেকার কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ ও মেজর হাফিজের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখান থেকে বাংলাদেশের কসবা বর্ডারের বেলতলা পাঠানো হয়। তারপর বড় যোদ্ধাদের সঙ্গে আমি ও কসবার লতুয়ামোড়া, চন্দ্রপুর, কসবা পুরাতন বাজার, মোগড়া মনিয়ন্দসহ অনেক জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত করা হয়।
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক জানান, একদিন হাবিলদার আবদুল হালিমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মনিয়ন্দ গ্রামে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কয়েক দিন পর তারা ১০ জন রাতে আবার পাক সেনাদের বাঙ্কারের কাছে গিয়ে অধিনায়কের নির্দেশে গুলি করতে শুরু করেন। একসঙ্গে ক্রমাগত গুলি চলান তারা। পরে পাক সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক বলেন, একদিন কসবা হাইস্কুল সংলগ্ন চন্দ্রপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। আমি ছিলাম সেই যুদ্ধে বাঙ্কারের দায়িত্বে। চলছে প্রচণ্ড গোলাগুলি। মুক্তিবাহিনীরা একপর্যায়ে টিকে থাকাই খুবই কষ্ট হয়ে দাঁড়ালো। তাদের সামনে একটাই রাস্তা পিছু হটতে হবে। আর পিছু হটতে হলে একজনকে তো ব্যাকআপ দিতে হবে। নইলে যে সবাই মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আমি এগিয়ে আসি। ছোট্ট কাঁধে তুলে নিলাম বিশাল এক দায়িত্ব। ক্রমাগত গুলি করতে লাগলাম পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। আর সেই অবসরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল আমাদের লোকজনরা। গুলির ধরন দেখে পাকবাহিনী মনে করলো, মুক্তিযোদ্ধারা খুব সংগঠিতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। ফলে তারা পিছু হটে গেলো। আমি তখন বাঙ্কারে রয়ে গেলাম। এক সময় রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে গেলো। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিল আমি নিশ্চয়ই শহীদ হয়ে গেছি। কিন্তু বাঙ্কারে গিয়ে সবাই দেখল আমি বসে আছি।
যুদ্ধের সময়কার একটি ভয়াবহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে বীর প্রতীক আবু সালেক বলেন, কসবার চন্ডিদোয়ার আর লতুয়ামোড়া এলাকায় একটি অপারেশনের কথা বলা হয়। সেখানে পাকদের একটি ক্যাম্পে প্রায় দেড়শ সেনা ছিল। আমাদের প্রায় আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা ওই ক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে। কথা ছিল ভোর ৫টা থেকে সোয়া ৫টার মধ্যে ওই ক্যাম্পে বোমা ফেলা হবে। কিন্তু সময় মতো বোম্বিং করা হচ্ছিল না। এ নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়ে যাই। দিনের আলো পরিষ্কার হতে দেখে এক পর্যায়ে আমরা আক্রমণ শুরু করি। ক্যাম্পটি ছিল পাহাড়ের মধ্যে। সম্মুখযুদ্ধে অনেক পাক সেনা নিহত এবং আমাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। ওই সময় আমিসহ চারজন এক বাঙ্কারে ছিলাম। শত্রুপক্ষের ছোড়া শেলের আঘাতে আমিসহ আরো ২ জন আহত হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক। তার ডান হাতের ক্ষতস্থান দেখলে এখনো গা শিউরে উঠে। হাতের একটি অংশে মাংস এখনো দেবে আছে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে জখমের চিহ্ন।
তিনি আরো বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ও দেশের টানে আমরা যুদ্ধে গিয়ে ছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল একটা, দেশকে শত্রুমুক্ত করা, দেশকে স্বাধীন করা। লাখো শহীদের রক্তের বিনীময়ে আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করায় আজ মানুষ আমাদেরকে সম্মান করছে। পরিবারের কাছে আমরা শ্রদ্ধার পাত্র। এটাই সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। সবচেয়ে বড় পাওয়া। স্বাধীন দেশটাকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবাইকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার আমাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানের ও মর্যাদায় রেখেছেন। আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
Posted ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin