শনিবার ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফসল বিক্রির টাকায় কলেজ নির্মাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   সোমবার, ২০ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট

ফসল বিক্রির টাকায় কলেজ নির্মাণ

ফসল বিক্রির লাভের টাকা আর নিজ জমিতে কলেজ নির্মাণ করেছেন ছানোয়ার হোসেন নামের এক কৃষক।

স্থাপিত কলেজে বোর্ড নির্ধারিত শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন ভালোবাসার কৃষি উৎপাদনমুখী শিক্ষা নামের একটি ক্লাস কার্যক্রম। এতে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি কৃষি শিক্ষা পাচ্ছে কলেজে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা।

এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ স্থানীয় শিক্ষানুরাগীরা।

কৃষক মো. ছানোয়ার হোসেন (৫০) টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামের মো. জামাল উদ্দিনের ছেলে। ছানোয়ার হোসেন পেশায় একজন কৃষক হলেও ১৯৮৮ সালে মধুপুরের চাপড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯০ সালে কালিহাতী কলেজ থেকে এইচএসসি আর ১৯৯২ সালে মধুপুর কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

২০১৩ সালে ছানোয়ার হোসেনের ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৩৫ শতাংশ জমির জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন মহিষমারা কলেজ। ২০২২ সালে কলেজটি এমপিওভুক্তি লাভ করে। বিজ্ঞান ও মানবিক এই দুই বিভাগের কলেজটির বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩২৭ জন। এর মধ্যে একাদশ ও দ্বাদশ মিলে বিজ্ঞান বিভাগে ৫২ আর ২৭৫ জন রয়েছে মানবিক বিভাগে অধ্যায়নরত।

শিক্ষার্থী বেতন বিজ্ঞান বিভাগে ৩০০ আর মানবিক বিভাগে ২৫০ টাকা। কলেজের স্টাফ সংখ্যা ১৭জন। এর মধ্যে শিক্ষক ১২জন। অধ্যক্ষ ব্যতিত বিজ্ঞান বিভাগে ৪ জন, মানবিক বিভাগে ৪ আর বাংলা, ইংরেজী আর আইসিটি বিষয়ে ৩ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি কক্ষ বিশিষ্ট কলেজের একটি একতলা একাডেমিক ভবন। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ভবনটি নির্মাণ করে। ভবনের সামনেই রয়েছে নজর কারা বড় একটি কৃষি বাগান। বাগান জুড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ সূর্যমুখী ফুলের গাছ, মাঝে টমেটো, মরিচ, পাতাকফি, ঢেঁঢ়শ, পেঁয়াজ, রসুন, বড়ই, লাল, পালংসহ নানা ধরণের শাক সবজি ও ডালিয়া, গাঁদা ফুলের বেশ কিছু গাছ। ওই বাগানের পাশেই রয়েছে উৎপাদনমুখী শিক্ষা নামের একটি সাইন বোর্ড।

তাতে লেখা রয়েছে বছরব্যাপি ফসল উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও গবেষণা কার্যক্রম। তবে শুরু দিকে কলেজটি ছিল টিনসেড।

রফিক, মনসুরসহ একাধিক এলাকাবাসী বলেন, ছানোয়ার হোসেন একজন বড় মনের মানুষ। গ্রামের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখার জন্য নিজের জমিসহ কৃষি থেকে কষ্টে উপার্জিত টাকায় মহিষমারা কলেজটি নির্মাণ করেছেন। কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগও দিয়েছেন স্বচ্ছভাবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষাও দিচ্ছেন তিনি। তার কাজ সবাই পছন্দ করেন। এ থেকে অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন বলেও জানান তারা।

কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী রহিমা বলেন, লেখাপড়া পাশাপাশি উৎপাদনমুখী শিক্ষাটি খুবই ভালো লাগছে। নিজেদের খাবার নিজেরাই যেন উৎপাদন করে খেতে পারি সে জন্যই উৎপাদনমুখী শিক্ষা গ্রহণ করছি।

কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মনির হোসেন বলেন, উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো ফলাফল বা নম্বর দেয়া হয়না। এইচএসসি বা একটা শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েই সবাই চাকরির পেছনে দৌড়াই, সবাইকে চাকরি করতে হবে এটা কোন কথা না। এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সফল কৃষক ছানোয়ার হোসেন কলেজ পর্যায়েই কৃষি শিক্ষা দিতে এই উদ্যোগ নিয়েছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমার যেন উৎপাদনমুখী শিক্ষা গ্রহণ করি, সে চেষ্টায় তার। কৃষি শিক্ষা নিতে আমাদের খুবই ভালো লাগে। এখানে কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে কাজ করি। এরইমধ্যেই আমরা পেঁয়াজ ও আলু রোপণ করেছিলাম। তিন কেজি আলু থেকে আমরা ত্রিশ কেজি আলু পেয়েছি। এক মাচায় ১২ মাস সবজি আবাদ করবো সেই ব্যবস্থা আমাদের এখানে আছে। উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আমাদের ৫টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি শনিবার ভোর ৬টা থেকে এ কার্যক্রমে আমরা অংশগ্রহণ করি। এখানে উৎপাদিত ফসল আমরা বিক্রি করে উৎপাদনমুখী শিক্ষা ফান্ডে জমা করি।

কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মো. রবিউল ইসলাম বলেন, উৎপাদনমুখী শিক্ষায় আমাদের শরীর চর্চা হচ্ছে। এ শিক্ষাকে আমরা বিনোদন হিসেবে নিয়েছি। এই বাগানের সকল শাক সবজিই আমরা রোপণ ও পরিচর্যা করি। আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছানোয়ার হোসেন এক সফল কৃষক। তার অনুপ্রেরণায় আমরা এই উৎপাদনমুখী শিক্ষা গ্রহণ করছি। এ শিক্ষা আমাদের খুবই ভালো লাগছে। কৃষিকে যেন আমরা ছোট করে না দেখি সে লক্ষ্যেই তিনি আমাদের কাজটি করাচ্ছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি কৃষি কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে আমি গর্ব বোধ করি। ভবিষ্যতেও কৃষি কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন তিনি।

কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, কৃষি প্রধান দেশ আমাদের। এছাড়াও আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছানোয়ার হোসেন একজন কৃষিমনা মানুষ। তিনি কৃষিকে ভালোবাসেন। তার উদ্যোগেই কালেজ প্রাঙ্গণে আমরা উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্যই একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের বাবা মা যে কৃষি কাজ করেন, সেটা যেন তারা করতে পারে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পরও যেন তারা কৃষি কাজ করতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই আমরা কলেজের সকল শিক্ষার্থীকে এই উৎপাদনমুখী শিক্ষায় সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করছি। এই বাগানের সকল সফলই শিক্ষার্থীদের হাতে রোপণকৃত। আমরা চাই এই শিক্ষার্থীরা যেন বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর কৃষিকে ভুলে না যায়।

কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামের ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা খুবই কষ্টকর। এ এলাকার চারদিকের প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কলেজ নেই। এ কারণসহ এলাকার ছেলে মেয়েদের কীভাবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়, সে ভাবনা থেকেই কলেজটি করা।

তিনি বলেন, বংশ পরম্পরায় আমি কৃষক। প্রায় ৩৫ বছর যাবৎ আমি কৃষি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এর মাঝে ১৯৯৩ সালে সিলেটের রেঙ্গাহাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ বছর ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে আর ঘাটাইলের গারোবাজার সুনামগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ২ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি। তবে শিক্ষকতা পেশা ভালো না লাগায় আবার কৃষিতে ফিরে আসি। যদিও কৃষিতে আমাদের কোনো সিলেবাস নেই। এরপরও সিলেবাস বিহীন কৃষিতেই আমি সফল মানুষ। তবে আমার হিসেব আলাদা, আমার হাত দিয়ে যদি আমি কিছু খাইতে চাই, সে ক্ষেত্রে যে শক্তির প্রয়োজন আছে। ওই হাত দিয়েই সেই খাদ্যটা উৎপাদন করে আমাকে খাইতে হবে। এই ভাবনা মাথায় রেখেই আমার এই উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।

তিনি আরো বলেন, এই দেশে সাড়ে ৩ কোটি তরুণ ও যুবক আছে, যারা নিজেদের বেকার মনে করে। ওই তরুণ ও যুবকরা যদি কৃষিতে আত্ম নিয়োগ করে আর কিছু কিছু উৎপাদন করে তাহলে আমাদের দেশে যে পরিমাণ জমি আছে তাতে ১৭-১৮ কোটি না ৩৬ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

এই বিশ্বাস থেকেই আমি উৎপাদনমুখী কার্যক্রমটি শুরু করেছি। এখানে বই পড়ে শেখা না, দেখে দেখে আর কাজ করে শেখা। এই বাগানে যা দেখা যাচ্ছে সবই কলেজের ছেলে মেয়েরা করেছে। ওদের মধ্যে যারা ভালো করে তাদের দিয়ে অন্যদের শিখাই। ওদের মধ্যেই ছাত্র, ওদের মধ্যেই শিক্ষক। এখানে তিনশ শিক্ষার্থী আছে, ওই তিনশ শিক্ষার্থীর বাড়িতেও যদি কিছু কিছু উৎপাদন করতে পারি তাহলে সেটি দেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে। আমি সেই শক্তিশালী লোকগুলো তৈরি করে দিচ্ছি, যাদের থাকবে উৎপাদনের হাত। ওই হাতে ফসল উৎপাদন হবে আরেকজনে খাবে।

ছানোয়ার বলেন, এ দেশে সার্টিফিকেটের কী কোনো মূল্য আছে? মানুষকে ৯৫ ভাগ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে প্রকৃতি থেকে। আমরা সেই শিক্ষাটিই দিচ্ছি।

মহিষমারা কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কলেজটি আজ তার প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের থেকে তুলনামূলক দূর্বল শিক্ষার্থীরা কলেজটি ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও এরই মধ্যে এইচএসসি সম্পন্ন করেছে কলেজের ৭টি ব্যাচ।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অধ্যায়নরত রয়েছে এ কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে ৫জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ আর জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২জন। গত এইচএসসি পরীক্ষায় ৯৬ জন শিক্ষার্থীর ৯৫জনই পাস করেছে। এর মধ্যে ৩জন গোল্ডেন এ প্লাসসহ ১৬জন পেয়েছে এ প্লাস।

তিনি আরো বলেন, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা কৃষক ছানোয়ার হোসেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। বেকার সমস্যা নিরসন আর কৃষি বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টায় কলেজে উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শিক্ষার্থীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন এ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে।

এ বিষয়ে মহিষমারা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মহির উদ্দিন জানান, কৃষি প্রেমী মানুষ ছানোয়ার। কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও ভবনসহ সরকারি নানা সহযোগিতাও পাচ্ছে কলেজটি। কলেজটি হওয়ায় স্থানীয় শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতেও তাদের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৪:২৭ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২০ মার্চ ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]