বৃহস্পতিবার ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জাতীয় স্মৃতিসৌধ: ৭ স্মৃতির ৭ স্তম্ভে বাঙালির মর্মগাথা

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট

জাতীয় স্মৃতিসৌধ: ৭ স্মৃতির ৭ স্তম্ভে বাঙালির মর্মগাথা

সাভারের নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অবস্থান। ঢাকা থেকে যার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য এ স্থানটি নির্বাচনের অনেক কারণ ছিল। এর অন্যতম কারণ, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে অনেক গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। ১৯৭২ এর ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে সৌধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর নকশা তৈরি করেন স্থপতি মইনুল হোসেন। সাতটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ দিয়ে মূল সৌধটি গঠিত, যা ছোট হতে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উপরে উঠে গেছে। এর উচ্চতা ১৫০ ফুট।

এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স। এখানে রয়েছে আকর্ষণীয় প্রশস্ত প্রবেশ পথ, পথের দুপাশে নানা জাতের ফুলগাছ, কৃত্রিম জলাশয়, উন্মুক্ত মঞ্চ, সেতু, ফুলের বাগান, অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও হেলিপ্যাড, মসজিদ, রেস্তোরাঁ। নানা জাতের ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের সমাহার রয়েছে এই কমপ্লেক্সে। অধিগ্রহণকৃত ৮৪ একর জমির মধ্যে প্রায় ৬৪ একর জুড়েই রয়েছে সবুজ বনভূমি। ৪০ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে স্মৃতিসৌধ।

কংক্রিট নির্মিত স্তম্ভগুলো শুধু স্মৃতিসৌধ নয়। এর মাধ্যমে জাতির মুক্তির সাতটি পর্যায়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরিক্রমাকে স্মরণ রাখতে সাতটি ঘটনাকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। যে ইতিহাস মাথায় রেখে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। চলুন আজ জেনে নেই।

১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এই আন্দোলনে আমরা সবচেয়ে বেশি শুনতে পাই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরের নাম। এর বাইরে আর কে কোথায় শহিদ হয়েছেন তা খুব একটা জানা যায় না। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর ভাষা শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণ রাখতে নানা স্থাপনা সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের সাতটি স্তম্ভের প্রথমটি (পেছন থেকে) সেসব স্থাপনারই একটি। প্রথম স্তম্ভটির উচ্চতা কম হলে ও প্রস্থে সবচেয়ে বড়।

২. ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন

পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ বারবার পিছাতে থাকে। অবশেষে ১৯৫৪ সালের মার্চে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘোষিত হয়।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। এর মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩টি, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ১৯টি, গণতন্ত্রী দল ১৩টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি ও পরে যোগ দেওয়া স্বতন্ত্র ৮টি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয়, তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়।

এই নির্বাচনের স্মৃতিকে স্মৃতিধন্য করে রাখতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর দ্বিতীয় পিলারটি তৈরি করা হয়।

৩. ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন

ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান যা ১৯৫৬ সালে প্রণীত হয়। এই সংবিধান ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এই সংবিধানের ১৩টি ভাগ, ২৩৪টি অনুচ্ছেদ ও ৬টি তফসিল ছিল। এই সংবিধানের মাধ্যমে পাকিস্তান অধিরাজ্য ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান নাম গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে যুক্তরাজ্য থেকে পাকিস্তান স্বাধীন হয়, কিন্তু ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো ব্রিটিশ অধিরাজ্য হিসেবে বহাল ছিল। ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ধারা ৮ এর অধীন, ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ কিছু সংশোধনী সহকারে পাকিস্তানের সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল ১৯৫৬ পর্যন্ত। কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল। তাই স্বাধীনতা আইনের অধীনে প্রথম পাকিস্তানের গণপরিষদ গঠিত হলে গণপরিষদ প্রথমে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়।

এ স্মৃতিকে ধরে রাখতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর তৃতীয় পিলারটি তৈরি করা হয়।

৪. ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন

পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমসাময়িক শিক্ষা ও রাজনৈতিক অবস্থানকে মুখ্য করে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে আইয়ুব খান এদেশের মানুষকে অধিকারবঞ্চিত করে। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহীত শিক্ষানীতি এ অঞ্চলের ছাত্রসমাজকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ কারণে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি এদেশের মানুষের শিক্ষার মেরুদণ্ডকে শেষ করে দেওয়ার যে অপকৌশল হিসেবে ১৯৬২ সালের শিক্ষানীতি ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্রসমাজের শিক্ষা আন্দোলন ছিল তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের আন্দোলন।

এ স্মৃতিকে ধরে রাখতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর চতুর্থ পিলারটি তৈরি করা হয়।

৫. ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন

ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৬ দফা দাবি’ পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিস্তম্ভ স্বরূপ। ছয় দফা বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’।

এ ইতিহাসকে ধারণ করতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর পঞ্চম পিলারটি তৈরি করা হয়।

৬. ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এ অভ্যুত্থানে অনেক মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এদের মধ্যে ডক্টর শামসুজ্জোহা, সার্জেন্ট জহুরুল হক, শহিদ আসাদ ছিলেন অন্যতম।

সেই ভয়ার্ত স্মৃতিকে স্মরণ করেই জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর ষষ্ঠ পিলারটি নির্মাণ হয়।

৭. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ ইতিহাস হয়তো আমাদের সবারই জানা…..।

এই সাত ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করেই বাংলাদেশে জাতীয় স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]