দয়াল কুমার বড়ুয়া | মঙ্গলবার, ০৪ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট
বিদেশে বাংলাদেশের ১ কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান দেশের অর্থনীতি পরিপুষ্ট করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির ওপরে। ১ কোটি মানুষ বিদেশে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত থাকায় তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করছে। এ-সংখ্যক লোক দেশে থাকলে বছরে অন্তত ৫ কোটি মণ চাল লাগত। বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে দেশের অর্থনীতি ফোকলা হয়ে যেত। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা বিরাজ করায় দুনিয়াজুড়ে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে রবিবার গণভবনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানসংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র এবং জনশক্তি পাঠানোর দেশ খুঁজে বের করার ওপর জোর দিয়েছেন। বলেছেন, দূতাবাসগুলোয় নির্দেশনা দেওয়া আছে, এখনকার কূটনীতি শুধু রাজনৈতিক নয়, এটা অর্থনৈতিক কূটনীতির স্তরে নিতে হবে। প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে কারও ধোঁকায় যাতে কেউ না পড়ে, সেজন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। বলেছেন, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা বিদেশ যাচ্ছেন তারা নয়, বিপদে পড়ছেন যারা দালাল ধরে যাচ্ছেন তারা। তাদের বিপদ হলে উদ্ধারও করতে হয় সরকারকেই। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে কোন দেশে কী কী দক্ষতা প্রয়োজন, সেভাবেই বহুমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মী তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রবাসে গিয়ে কারও ধোঁকায় কেউ যাতে না পড়েন, সেজন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে তা অন্য খাতে চলে যায় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনেক সময় টাকা বেহাতও হয়ে যায়। তাই বৈধ পথে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে সবার জন্যই ভালো। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কী করণীয় সে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠেছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে জনশক্তি রপ্তানি বাড়বে। সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প নাই। অনেক দেশ এখন বয়োবৃদ্ধের দেশে পরিণত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের বড় বিষয় হলো আমাদের বিপুলসংখ্যক যুব শ্রেণি আছে। শ্রমবাজারে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে যুবকদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে।
সারা বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের প্রধান রফতানিমুখী তৈরী পোশাক সেক্টরে হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক উচ্চ বেতনে কাজ করছে। এভাবে দেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। মূলত তৈরী পোশাক খাত এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি।
আশার কথা হচ্ছে, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা সদর ও উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি শত শত কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব টেকনিকেল ট্রেনিং সেন্টার(টিটিসি) থেকে যেসব শ্রমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়ে আসছে এদের জন্য দেশে-বিদেশে যথাযথ কর্ম সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এমন বাস্তবতায় বিকল্প শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। সম্ভাব্য দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় জনশক্তির চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে উপযুক্ত কর্মী প্রশিক্ষণ ও জনবল গড়ে তোলার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
সময়ের চাহিদা অনুসারে শ্রমিকের আধুনিক প্রযুক্তিগত ও কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি নির্দিষ্ট দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও সিভিক নিয়ম কানুনও প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। শুধু কারিগরি শিক্ষাই নয়, দেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকেও সময়ের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে সংস্কার বা ঢেলে সাজানোর সুচিন্তিত উদ্যোগ নিতে হবে।
বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের নামে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। বছরের পর বছর ধরে এ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রতি বছর কত মানুষ পাচারের শিকার হয়, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। বিদেশে-বিভুয়ে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশীদের গ্রেফতার কিংবা জিম্মি হওয়াসহ মৃত্যুর খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এতে অনুমান করা যায়, পাচারের সংখ্যা মোটেই কম হবে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা পাচার হচ্ছে, তারা দেশের সক্ষম জনসংখ্যারই অংশ। তারা পাচারকারীদের কবলে পড়ে বিদেশের পথে পথে বা বিদেশে বিড়ম্বিত, লাঞ্ছিত, আটক ও জিম্মি হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কর্মসক্ষমতা বিনাশ করছে। প্রতারিত ও হতাশ হয়ে দেশে ফিরে আসছে। অনেকে মৃত্যুবরণও করছে। এটা দেশের কর্মশক্তির ক্ষয় ও অপচয়। মানব পাচার মানে শুধু মানুষই পাচার নয়, এই সঙ্গে টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে চাকরিতে যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে হয়। সঙ্গেও নগদ কিছু নিয়ে যেতে হয়। আর আটক কিংবা জিম্মিদশায় পড়লে দেশ থেকে লাখ লাখ টাকা গুনে তবে মুক্তি পেতে হয়।
মানব পাচারের মত অপরাধ দমন বা নিরোধ করতে হলে প্রথমত, দেশব্যাপী মোটিভেশন কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনকে আরো কঠোর করতে হবে। তৃতীয়ত, এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তন কিংবা চাকরির জন্য বিদেশে যেতে হলে চোরাপথ বা অবৈধ পথ পরিহার করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেতে হবে। টাকা-পয়সা দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছতার আশ্রয় নিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, কারিগরি শিক্ষা হচ্ছে বর্তমানে জীবিকা অর্জনের একটি মাধ্যম। দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে দেশে এখন দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল বিদেশে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছি। তাই সকলকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি।
Posted ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৪ এপ্রিল ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin