দয়াল কুমার বড়ুয়া | সোমবার, ১০ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট
চরের মানুষজন ছিল এক সময় সত্যিকার অর্থেই দুঃখী মানুষ। সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ। নদীভাঙন আর বন্যার কবলে পড়া ছিল তাদের জন্য অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। চরাঞ্চলে ছিল না রাস্তাঘাট। ছিল না বিদ্যুৎ কিংবা আধুনিক কোনো সুযোগ-সুবিধা। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ছুটতে হতো শহরে। আইনশৃঙ্খলার বালাই ছিল না চরাঞ্চলে। ফলে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা সহজেই আখড়া গাড়ত চরাঞ্চলে। এক যুগের মধ্যে দেশের সব চরাঞ্চলেই এখন পরিবর্তনের হাওয়া। বদলে গেছে তাদের দুঃখ-দুর্দশা বঞ্চনার দিন। নদীর তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে দুর্গম চরাঞ্চলে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমছে। ঘরে বসেই মিলছে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা।
চরের মানুষের হাতে হাতে এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন। দুর্গম চরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন তরুণ-তরুণীরা। উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে তপ্ত বালুচরে এখন সারা বছরই নানা ফসল ফলছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সেই ফসল যাচ্ছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেনসহ নানা দেশে। কাজের খোঁজে শহরে আসা অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন নিজের শেকড়ে। ক্রমেই চাঙা হচ্ছে চরের কৃষি অর্থনীতি। শুধু প্রতি বছর বন্যা আর নদীভাঙনই এখন চরের মানুষের সামনে মূর্তিমান আতঙ্ক। ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ৭০টির মতো সেবা পাচ্ছে চরের মানুষ। অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু সনদ, ভূমি পরিষেবা, পাসপোর্ট-ভিসার আবেদন, হজ নিবন্ধন, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন, চাকরির আবেদন, মোবাইল ব্যাংকিং সবকিছু তাদের নাগালে। দেশের কোনো অংশের মানুষ পিছিয়ে থাকলে সেটি সার্বিক অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে চরাঞ্চলের উন্নয়নে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের এক বড় অংশ নদীভাঙনের শিকার। বাড়িতে আগুন লাগলে সবকিছু পুড়ে গেলেও জমি থাকে। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে। কিন্তু নদীভাঙন মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এমন লাখ লাখ মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া দেশের মানবিক উন্নয়নেরই প্রতিবিম্ব।
এদিকে, পদ্মাসেতুকে ঘিরে পদ্মার পাড় সংলগ্ন এলাকায় ছোঁয়া পাচ্ছে আধুনিকতার। পদ্মাসেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের দিকে তাকালে যে কারোরই চোখ জুড়িয়ে যাবে। অ্যাপ্রোচ সড়কের ফলে সড়ক সংলগ্ন গ্রামগুলোতেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। যেখানে এক সময় ছিল কাঁদামাখা পথ-ঘাট, পানিতে ডুবে থাকা জলাশয়। আজ সেখানে প্রশস্ত সড়ক। সড়কের পাশে গড়ে উঠছে নানা ধরনের দোকান। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের স্থাপনা।
পদ্মার চরাঞ্চলের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। অবহেলিত চরে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় এ সব এলাকায়ও গড়ে উঠছে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান। কলকারখানা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কাজের সুযোগ তৈরি হবে এ অঞ্চলের অনেক মানুষের। সব মিলিয়ে নদীভাঙা, রোদে পোড়া চরের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে সেই দিনটি খুব দূরে নয়। এমনটিই ভাবনা চরের মানুষের।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে তথ্যপ্রযুক্তির সম্পৃক্ততা অনস্বীকার্য। যারা উপজেলা বা গ্রামে থাকে তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ নয়। ইন্টারনেটের যুগে গ্রাম আর শহরে কোন পার্থক্য নেই। উপজেলা পর্যায়েও পৌঁছে গেছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের লাইন। মোবাইলের ইন্টারনেটও সহজলভ্য। এখন দরকার শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে এর স্বদব্যবহার শেখানো। তাহলেই দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবো।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি ছিল দেশবাসীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করা। দুনিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশে পাঁচ দশকে চাষযোগ্য জমি অর্ধেকে নেমে এলেও এবং জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ স্বাধীনতার আগে বিদেশে পুরনো পোশাকের ওপর নির্ভরশীল ছিল সে দেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক। চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশে। গৃহহীনদের গৃহদান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পূরণে দেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে- এমনটিই প্রত্যাশিত।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি।
Posted ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১০ এপ্রিল ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin