রবিবার ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আফগানদের ছোলা-মুড়ি যেভাবে বাঙালির ইফতারে এলো

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট

আফগানদের ছোলা-মুড়ি যেভাবে বাঙালির ইফতারে এলো

ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু—বাঙালির ইফতারে এসব পদ যেন অনবদ্য। খেজুর মুখে দিয়ে রোজা ভাঙার পর ছোলা-মুড়ি না পেলে বেশিরভাগ বাঙালির যেন তৃপ্তিই মেটে না। তাই তো বাংলাদেশের সব বাড়িতেই ইফতারের প্রধান আকর্ষণ ছোলাসহ নানারকম ভাজা-পোড়া খাবার। শুধুমাত্র বাড়িতেই নয়, এই সময় খাবারের দোকানগুলোতেও এরকম মশলাদার ইফতারি বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়।

রমজানের পুরো মাসজুড়ে ছোলা-মুড়ির আধিক্য দেখা গেলেও বছরের অন্য সময় এভাবে নিয়মিতভাবে খাওয়া হয় না। ধর্মীয় বিধিবিধানেও ইফতারে এমন মুখরোচক খাবারের রীতির উল্লেখ আছে বলে শোনা যায় না। তাহলে বাঙালির ইফতারের প্লেটে এরকম মুখরোচক ভাজা-পোড়া খাবার জায়গা করে নিলো কীভাবে?

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছেন, বাঙালি সংস্কৃতিতে ইসলামে ইফতারির সময় কয়েকশো বছর পূর্বের বর্ণনাতেও এরকম ভাজাপোড়া খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুতরাং বলা যায়, কয়েকশো বছর আগেও এগুলো ছিল না।

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এখন যেভাবে ইফতারে নানারকমের মুখরোচক খাবার, মাংস, জিলাপি বা ভাজাপোড়া খাওয়া হয়ে থাকে, সেটা মাত্র কয়েকশো বছরের পুরোনো। উনিশ শতকের দিক থেকে এরকম খাবার এই অঞ্চলের মানুষজন খেতে শুরু করেছে বলে ধারণা করা যায়। কারণ এর আগে বইপত্রে এরকম রকমারি খাবারের বর্ণনা পাওয়া যায় না।

কোন খাবার কোথা থেকে এসে যোগ হলো

খেজুর: হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতারের সময় খেজুর খেতেন। ফলে ইফতারের সময় খেজুর খাওয়াকে সুন্নত বলে মনে করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের থেকে এই রীতিটি সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বেই ইফতারের সময় খেজুর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ বলে মনে করা হয়।

ছোলা: এটা আফগানদের প্রিয় খাবার, তাদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের, বাংলাদেশের মুসলমানরা গ্রহণ করেছে। তারা কাবুলি চানা বা কাবুলি ছোলা খেয়ে থাকে। সেখান থেকেই এটা খাওয়ার চল এসেছে। তবে ভারত বা বাংলাদেশে এসে সেটা আরো মশলা, পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে মুখরোচক করে রান্না করা হয়ে থাকে। সেটার সাথে মুড়ি খাওয়ার চলও এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব উদ্ভাবন।

বলে রাখা ভালো, শবেবরাতের সময় যে বুটের হালুয়া তৈরি করা হয়, সেটার আসল নাম যেমন হাবশি হালুয়া, এটাও আফগানদের একটা খাবার।

পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ: এটা উত্তর ভারত থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন এলাকার খাবারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে বলছেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুসরাত ফাতেমা। তিনি বলেন, ভারতে এসে, মূলত উত্তর ভারত থেকে ইফতারের সময় মুখরোচক খাবারের অংশ হিসাবে নানা রকমের ভাজাপোড়া খাওয়ার চল যোগ হয়েছে। তখন পেঁয়াজু, বেগুনি, নানা ধরনের চপ বানানোর চল যুক্ত হলো। সেটাই পরবর্তীতে আমরাও গ্রহণ করেছি।

কাবাব, হালিম, বিরিয়ানি: মুঘল খাবারের মধ্যে পারসিক খাবারের প্রভাবটা অনেক বেশি ছিল। তারাই ইফতারে বিরিয়ানি, কাবারের মতো খাবার খেতো। সেটা দেখে এই অঞ্চলের বনেদি মানুষজনও খেতে শুরু করেন। এখনো ইরান, আরব আমিরাত, সৌদি আরব ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ইফতারির সময় কাবাব সহযোগে বিরিয়ানি বা পোলাও খাওয়ার চল রয়েছে।

শরবত: ইফতারে শরবত খাওয়ার রীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতে রয়েছে। পানির পিপাসা থেকে স্বাদ, মিষ্টি ও সুগন্ধি শরবত খাওয়ার চল চালু হয়েছে বলে মনে করেন ইসলামি ইতিহাসবিদরা।

কেমন ছিল উনিশ শতকের ইফতার?

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, শবেবরাতের পর থেকেই শুরু হয়ে যেত রমজানের আয়োজন। পরিষ্কার করা হত পানির পাত্রগুলো। কেনা হতো নতুন শরা, মাটির হুঁকা ইত্যাদি। সেগুলোকে বাসায় এনে সুরভিত করা হত সুগন্ধি দিয়ে। গরমের দিনে পানি ঠান্ডা রাখার জন্য আনা হত বালুর তৈরি সুরাহি। সেভাবে রাখা পানিকে সুগন্ধি করার জন্য দেওয়া হত গোলাপ ও কেওড়া। সে সময় ইফতার করাকে বলা হত ‘রোজা খোলাই’, মানে খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা খোলা বা ভাঙা। আর এই রোজা খোলাইয়ের আয়োজন বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে যেত জোহরের পর থেকেই।

বাড়ির নারীরা রান্নাঘরে যেতেন। আগে থেকে ভেজানো ছোলা, মুগডাল বের করা হত। ডাল বেঁটে তৈরি করা হত ফুলুরি। যথাযথ চেষ্টা করা হত ইফতারের সময় সেটা যেন গরম গরম পরিবেশন করা যায়। আজান শোনার পর ইফতার শুরু হত জমজম কূপের পানি মেশানো শরবত দিয়ে। আর শরবতের মধ্যে থাকত ফালুদা, তোকমার শরবত, বেলের শরবত, বেদানার শরবত, লেবু ও তেঁতুলের শরবত। তোকমার শরবতের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল তাখসে রায়হান।

শরবতের পর সওয়াবের কাজ হিসেবে খোরমা খাওয়া হত। এর পরই রোজাদার চলে যেতেন ইফতারের মূল পর্বে। আর সেটার জন্য পরিবারের ছোট-বড় সবাই হাজির হতেন দস্তরখানায়। ঘরে বানানো মুড়ির বিভিন্ন পদ, মিষ্টি ও নোনতা সমুচা, কাঁচা ও ভাজা ডাল, ফল-ফলারি, পেঁয়াজু, ফুলুরি প্রভৃতি বাজার থেকে কিনে আনা হত। ছিল ‘গোলাপি ঊখরা’ নামের মিষ্টি মিশ্রিত এক ধরনের খাবার। এছাড়া ভুনা চিঁড়া, দোভাজা, টেপি ফুলুরি, মাষকলাইয়ের বড় ডাল-বুট, বাকরখানি, কাবাব ইত্যাদি হাজির থাকত দস্তরখানায়।

ঘরে বিভিন্ন ধরনের ইফতারি বানানো হলেও পুরান ঢাকাবাসী প্রতিদিন চকবাজার থেকে কিছু না কিছু ঠিকই আনতেন। ধনী-গরিব সবাই আসতেন চকে। তখন ঢাকায় বিভিন্ন মহল্লার মসজিদেও ইফতারের আয়োজন হত। মহল্লার মসজিদে ইফতারি পাঠাতেন এলাকার ধনী ব্যক্তিরা। এই সময় বিশ শতকের প্রথম দিকেও ঢাকায় ইফতারির বাজার বলতে শুধু চকবাজারকে বোঝাত।

তবে চল্লিশের দশকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে ইফতারির অস্থায়ী দোকান। এটা অবশ্য চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইফতারির সঙ্গে যোগ হয় গ্রামবাংলার পিঠা-পুলি। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রমজান ও ইফতারের আয়োজন ও বৈচিত্র্য বেড়ে যায় অনেক গুণ।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

(224 বার পঠিত)
(202 বার পঠিত)
advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]