নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট
পবিত্র রমজান মাসে খেজুর না হলে ইফতারই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রমজান ছাড়াও অন্য সময় বাংলাদেশে খেজুরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ধর্মীয় দিক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য ও খাবারের দিক থেকে অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে খেজুরে। বর্তমানে বাজারে নানা ধরনের খেজুর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে দেশে দিন দিন খেজুরের চাহিদাও বেড়েছে। এই বাড়তি চাহিদার সুযোগে অসৎ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মানভেদে খেজুরের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।
বাংলাদেশে সুস্বাদু খেজুর তেমন উদপাদন হয় না। যা হয় তা যৎসামান্য। প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে প্রায় ৬০০ ধরনের খেজুর। এর মধ্যে কেবল পাঞ্জাবেই রয়েছে ৩০০ ধরনের খেজুর। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসে ২৮ ধরনের খেজুর। এগুলোর আবার নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বাংলাদেশে ঢাকার বাদামতলীকেন্দ্রিক খেজুরের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এখানের বড় বড় আড়ৎ থেকে সারাদেশে বেশিরভাগ খেজুর সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ঢাকা, বিশেষ করে বাদামতলীর কিছু ব্যবসায়ী দেশে খেজুর আমদানি করে থাকেন। ফলে বাজারে তাদের প্রভাবও একচেটিয়া। তারা যে দাম নির্ধারণ করে দেন, সেটিই ক্রেতা-সাধারণকে গুনতে হয়। বর্তমানে বাজারে প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি বাদামতলী, কারওয়ান বাজার, পল্টন মতিঝিল ঘুরে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এবার একই জাতের খেজুরের মূল্য আকাশচুম্বি। কোথাও ২০ গুণ, কোথাও দশগুণ, কোথাও ৩ গুণ বেশি দামে খেজুর বিক্রি হচ্ছে। ফলে সাধ্য না থাকায় অনেক ক্রেতাই পরিমাণে কম খেজুর কিনছেন। কম খেতে বাধ্য হচ্ছেন।
৬০ বছর বয়সী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আহসানুল করিম। গত মঙ্গলবার তিনি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খেজুর কিনতে আসেন। আজকের অগ্রবাণীকে তিনি বলেন, গত তিনদিন আগেও এখান থেকে আধাকেজি খেজুর কিনেছি। আজও এই দোকান থেকে নরম জাতের অর্থাৎ গালা খেজুর কিনেছি। আধাকেজির দাম ১৫০ টাকা। যা গত বছর ছিল ১০০টাকারও কম।
আহসানুল করিম বলেন, বাজারে খেজুরের চড়া দাম। পরিমাণে কম না কিনে উপায় নেই। খেজুরের মান কেমন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই খেজুরের মান তেমন ভালো নয়। কিন্তু উপায় নেই। কী করবো? এই গালা খেজুরের কেজিই ৩০০ টাকা। অন্যগুলোর দাম তো আরো বেশি। সেগুলো কেনার সাধ্য আমাদের নেই। শুধু আমি নই, আমার মতো বহু মানুষ আছে, যাদের এই গালা খেজুরই ভরসা।
এদিকে, সরেজমিন খেজুরের দাম ও মানের গল্প খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে অন্য গল্প। খেজুর ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছে কমিশন এজেন্ট বাণিজ্য। খোদ আমদানিকারকরাই এর নিয়ন্ত্রক। তারা ১০০টাকার খেজুর ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। খুচরা ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা এমন অভিযোগ করেন। তবে তারা কারো নাম বলতে রাজি হননি।
তবে আমদানিকারকরা বলছেন এলসি (ঋণপত্র) স্বাভাবিক না হলে পণ্য সরবরাহ আর দরদামে সমস্যা সৃষ্টি করে। এখন ১০০ শতাংশ মার্জিন দিয়ে সবকিছু আমদানি করার কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে আমাদের লাভ হয় খুব কম।
খেজুর নিয়ে কারসাজি
শুল্ক ফাঁকি দিতে উন্নতমানের খেজুরকে নিম্নমানের দেখিয়ে আমদানি করার তথ্য মিলেছে। এসব খেজুর আমদানি মূল্যের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি আমাদের অভিযানে বেশিদামে খেজুর বিক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় ফ্রেশ ফ্রুট গ্যালারিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ পাইকারি দোকানটি ঢাকাভিত্তিক বাংলাদেশের বৃহত্তম খেজুর আমদানিকারক অ্যারাবিয়ান ফ্রুট ফ্যাক্টরি লিমিটেডের। এর স্বত্তাধিকারী বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম।
শুল্ক ফাঁকির বিষেয়ে তিনি বলেন, অভিযোগ রয়েছে তিনি ও তার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিনসহ অন্যরা রমজান এলেই দেশি-বিদেশি ফল চড়া দামে বিক্রি করতে আমদানিকারক ও কমিশন এজেন্টদের মাধ্যমে একটা চক্র গড়ে তোলেন।
আজওয়া খেজুরের দুই রুপ
আজওয়া খেজুর শুকনো ও আধা শুকনো অবস্থায় পাওয়া যায়, যার মধ্যে আধা শুকনো খেজুরের গায়ে মাংসের পরিমাণ বেশি। কারণ, অন্যান্য খেজুরের তুলনায় এ খেজুরের বিচি ছোট। এ খেজুরের দাম ৮৪৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫০০ টাকা পর্যন্ত।
মতিঝিলে একই জাতের আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। অপরদিকে এই খেজুরই পল্টন ও বায়তুল মোকাররমে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। মাত্র ১০ মিনিট পথের ব্যবধানে কেজিতে বেড়ে গেছে ২০০ টাকা! আবার কারওয়ান বাজারেও ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে এই খেজুর।
কারণ জানতে চাইলে মায়ের দোয়া ট্রেডার্সের বিক্রয়কর্মী মো. মামুন বলেন, যারা যেমন কেনেন, তারা তেমন বিক্রি করেন। আবার খেজুর বিভিন্ন দেশের ও হরেকরকম হওয়ায় দাম কমবেশি হয়ে থাকে। এলাকাভেদেও দাম বেড়ে যায়। ভিআইপি এলাকা হলে দাম আরো বেড়ে যায়।
বাদামতলী পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, মেডজুল নামে এক ধরনের খেজুর ১৩৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ১০-১৫ ধরনের আজওয়া খেজুর বিক্রি হতে দেখা যায় বিভিন্ন আড়তে। মানভেদে ৫ কেজি আজওয়ার দাম ১২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
বিসমিল্লাহ ফল ভাণ্ডারে ৩০ ধরনের খেজুর বিক্রি করছেন মোতালেব সরদার। তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, আমরা মরিয়ম খেজুর ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করি। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি করেন। মিশর থেকে আনা বড় আকারের মেডজুল খেজুর আকারে বড় ও নরম হয়। এটি পাইকারিতে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং খুচরা দোকানে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরে দেশে ২৮ ধরনের খেজুর আমদানি হয়েছে। যার পরিমাণ ৫০ হাজার ২৫৭ টন। এতে ব্যয় হয়েছে ৪৭৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পার কেজিতে খরচ হয়েছে গড়ে ৯৪ টাকা ৯৬ পয়সা। কাস্টমসে একই এইচএস কোড (পণ্য শনাক্তকরণ নম্বর) শুল্কায়নে খেজুরের মান নিম্ন এবং দাম একই ধরা হয়েছে। মূলত আমদানির বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক ও কর ফাঁকি দিতেই এমন অপকৌশল বেছে নেন অর্ধশত আমদানিকারক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দর থেকে খালাসের পরই পাল্টে যায় চিত্র। উন্নত, মাঝারি ও নিম্ন- তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফেলা হয়। দেশের বিভিন্ন বাজারে কোথাও তিনগুণ, কোথাও ২০ গুণ মূলবৃদ্ধিতে এসব খেজুর বিক্রি করে সাধারণ ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, এখন কর্পোরেট ব্যবসার নামে কোম্পানিগুলো মনোপলি তৈরি করে রেখেছে। আমদানি বাজারে মনোপলির মাধ্যমের পণ্য আটকে রেখে বাজারের অবস্থা বুঝে পণ্য ছাড় করার যে প্রবণতা, এ জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরকম অসৎ চিন্তা পরিহার করতে পারলে এসব কারসাজিও বন্ধ হয়ে যেত।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মনে করেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দেশভিত্তিক শুল্কায়ন করলে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ কমে আসবে। কিন্তু তা না করে হঠাৎ দেড় থেকে আড়াইগুণ শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছে। আবার আড়াই কেজির ওপরে ও নিচের প্যাকেট এবং বস্তার প্যাকেটের ওপর শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে পণ্যের দাম বেশি হলে শুল্কহারও বেশি আসে। এজন্য শুল্ক ফাঁকির জন্য পণ্যের দাম কম দেখানোর মতো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এ অবস্থায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোক্তার ব্যয়ের বোঝা হালকা করতে ভোগ্যপণ্যের শুল্কহার কমানোর পরামর্শ দেন।
খেজুরের বাজারে অস্থিরতার বিষয়ে ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্দর থেকে খেজুর খালাসের সুযোগ দেওয়া হলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয় না।
এ সময় তিনি ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে বলেন, গত বছরের ৮৫ টাকার ডলারের দাম এখন ১০৫ টাকা। শুল্কও বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে পরিবহন খরচও বেড়েছে। ফলে আমদানি খরচও বেড়েছে। সবমিলিয়ের বাজারে এর একটা প্রভাব পড়েছে।
একই বিষয়ে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, চাল, ডাল ও তেলের বাজার যেভাবে মনিটরিং করার উদ্যোগ নেয়া হয়, খেজুরের ক্ষেত্রে সেটি দৃশ্যমান নয়। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটাই নিচ্ছেন।
বাদামতলীর শাকিল ফ্রেশ ফ্রুটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হক জানান, মান ও প্যাকিংয়ের ওপর নির্ভর করে দামও। পিপিই ব্যাগে খেজুর আসে। আসে ১০ কেজির কার্টনেও। পিপিই ব্যাগের তুলনায় কার্টনের দাম কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেশি থাকে। দামবৃদ্ধির পেছনে এসবের প্রভাবও পড়ে।
এক মরিয়মের তিন রুপ
অভিজাত শ্রেণির খেজুরের মধ্যে রয়েছে মেডজুল, আজওয়া ও মরিম। তবে এক মরিয়মের তিন রুপ হওয়ায় মানভেদে দামেও রকমফের হয়ে থাকে। ভালো মানের মরিয়ম খেজুরের রং উজ্জ্বল বাদামি, লম্বাটে আকার, প্রায় দেড় ইঞ্চির মতো লম্বা। স্বাদ খুবই মিষ্টি। ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে এই খেজুর। গত বছর যা ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
কালমি মরিয়ম
এ জাতের খেজুর মিশর, জর্ডান ও আলজেরিয়া থেকে আসে। এগুলো গাঢ় বাদামি ও কালচে রঙের ও ডিম্বাকৃতির। দাম ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। যা গত বছর ছিল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
সুফরি মরিয়ম
এ খেজুর হালকা বাদামি রঙের হয়। দাম ৬৫০ টাকা কেজি।
মেডজুল খেজুর
মেডজুল খেজুর আকারভেদে দুই ধরনের হয়ে থাকে। মেডজুল (ছোট ও মাঝারি) ১১৯৫ টাকা, মেডজুল প্রিমিয়াম ১৩৯৫ টাকা, আম্বার বিক্রি হচ্ছে ১২৪৫ টাকায়।
জুয়েল ও রয়্যাল
আম্বার ও সাফাভি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা কেজি। যা গত বছর ছিল ৬৫০ টাকা। সুক্কারি ৭৫০ টাকা কেজি, আদম ৬০০, জুয়েল ৭০০ টাকা, রয়্যাল ৫০০ টাকা, মাশরুক ৪৫০ টাকা, এছাড়া বরই খেজুর আকারভেদে ৪৫০ ও ২২০ টাকা। যা গত বছর ছিল ৩০০ ও ৩৫০ টাকা। গোলাকার এক রকমের খেজুরও বেশ বিক্রি হয়। যা আকার ভেদে ৪৩০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, সাধারণভাবে খেজুরের চাহিদা থাকে মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টন। কিন্তু রমজান মাসে এর চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার টন।
Posted ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin