মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সেন্টমার্টিন: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ০৫ জুলাই ২০২৩ | প্রিন্ট

সেন্টমার্টিন: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

মোখার তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। যে ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই প্রতি বছরের মতো সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।

অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকে বলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ বছরের ছয় মাস থাকে বন্ধ। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এ ছয় মাস কোনো পর্যটক সেখানে যেতে পারে না। সব মিলিয়ে এ উপকূলের মানুষের কাছে মোখার তাণ্ডবের পর, পর্যটকশুন্য দ্বীপ ও সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে দ্বীপের মানুষের প্রধান জীবিকার উৎসই মৎস আহরণ। সেখানে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রতিবছর প্রায় দুই মাস বন্ধ থাকে মাছ ধরা। যদিও সরকার থেকে সমুদ্রগামী নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন সেন্টমার্টিন এলাকার বাসিন্দারা। মাছ ধরতে না পারায় তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হয় সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ পাড়ার জেলে সুলতানের সঙ্গে। তিনি সময় সংবাদকে বলেন,

মোখায় আমার ঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক কষ্টে তা মেরামত করেছি। জমানো টাকা সব ঘরের পেছনেই চলে গেছে। এখন যে ঠিকমতো তিনবেলা খাব তার হিসাবই মেলাতে পারি না। এদিকে সমুদ্রেও মাছ ধরা বন্ধ। ট্যুরিস্টও নেই। খুবই বিপদে আছি ভাই।

শুধু সুলতানই নয়, এমন অনেকেই আছেন যারা এই সময়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অসহায় হয়ে পড়েছেন। কিছুদিন আগে সরেজমিনে সেন্টমার্টিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা যায়। শোনা যায়, সেখানকার মানুষের অসহায় আর্তনাদ। একদিকে যেমন ট্যুরিস্টশূন্য দ্বীপ অন্যদিকে ৬৫ দিনের জন্য সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় সাধারণ মানুষ পড়েছেন বিপাকে।

সেন্টমার্টিনবাসীর আয়ের আরেকটি বড় উৎস পর্যটক। বর্ষা মৌসুম ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকে বলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ বছরের এ সময়টাতে পর্যটক আসা-যাওয়া বন্ধ থাকে। পর্যটক ভ্রমণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে ১০টি জাহাজ চলাচল করে। দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বিধায় উপজেলা প্রশাসন এসব জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখে। ফলে পর্যটকশূন্য থাকে এই প্রবাল দ্বীপটি। আর পর্যটক না থাকলে এখানকার বাসিন্দাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তাদের খুবই কঠিন সময় পার করতে হয়। এবার মোখার আঘাত তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ও ক্রাস্টাসিয়ান্স (কঠিন আবরণযুক্ত জলজ প্রাণী, কাঁকড়া) এর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং মাছের মজুত সংরক্ষণ সুষ্ঠু ও সহনশীল আহরণ নিশ্চিত করার স্বার্থে ২০১৫ সাল থেকে এ নিয়ম চালু করে সরকার। ফলে প্রজনন মৌসুমের পর জেলেরা বিপুল পরিমাণ মাছ আহরণ করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, মোখার পর অনেকেই হারিয়েছেন ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরের একাংশ ও গাছপালা। যা মেরামত করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। সেখানে এ নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপর বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ৭.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপকে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ও বলা হয়। এখানে মূল দ্বীপ ছাড়াও ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ নামে আরও একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে। যেখানে ৬ হাজার ৭২৯ মানুষের (সরকারি তথ্য অনুযায়ী) বসবাস। এতো মানুষের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে পড়লে জনজীবনে কী রকম দুর্ভোগ আসতে পারে তা সহজেই ধারণা করা যায়।

এ বিষয়ে কথা হয় আরেক স্থানীয় বাসিন্দা নূর আলমের সঙ্গে। তিনি সময় সংবাদকে বলেন,

মোখার পর এখনো ঠিকমতো দাঁড়াতে পারিনি। পর্যটক থাকলে হয়তো তা পুষিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু এখন তো ট্যুরিস্ট আসা বন্ধ। তাই আয়ও নাই। আর আয় না থাকলে খামু কী কন? এদিকে সমুদ্রে যে মাছ ধরতে যামু তাও বন্ধ। কীভাবে যে ছেলে মেয়েগুলারে খাওয়ামু বুঝতেছি না।

সিজনের সময় পুরো সেন্টমার্টিন যেমন উৎসবমুখর থাকে, এ সময়ে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। জেটিঘাটে সিরিয়াল দিয়ে থাকে অটো। অথচ এখন একটা অটোও দেখা যায় না। ট্যুরিস্টবান্ধব দোকানপাটগুলোও বন্ধ। অনেক কষ্টে দেখা মেলে একটি অটোর। চালকের নাম আবদুর রহমান। তিনি সময় সংবাদকে বলেন,

স্থানীয় মানুষ তো আর ওইভাবে অটোতে ওঠে না। তাই অটো কম দেখা যায়। আমিও অনেকদিন পর অটো বের করলাম। পেটের দায়ে বের করছি। যদি দুই পয়সা আসে তাতে পেটে অন্তত ভাত জুটবে।

যেদিকে চোখ যায় শুধু নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্রের নীল সেখানে মিলেমিশে একাকার। সেই নীলই যেন বেদনা হয়ে ধরা দিয়েছে এখানকার মানুষের জীবনে। সাগরতীরে বাঁধা মাছ ধরার নৌকা-ট্রলার, সৈকতজুড়ে কাঁকড়া, ঝিনুক, গাঙচিলের পাশাপাশি স্বচ্ছ পানিতে জেলি ফিশ, হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ এবং প্রবাল এ দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ। নান্দনিক নারিকেল গাছের সারি যেন চিরল পাতায় দোলা দিয়ে যায়। অগভীর দীর্ঘ সমুদ্রতট, সামুদ্রিক প্রবাল, সাগরের ঢেউয়ের ছন্দ মুগ্ধতা ছড়ানো দ্বীপকে কেন্দ্র করে যাদের বাস তাদের অবস্থা দেখার কেউ নেই। অথচ অনিন্দ্যসুন্দর এ দ্বীপ দেখতে প্রতি বছর কত হাজার হাজার মানুষ আসেন।

এ বিষয়ে কথা হয় টেকনাফ জোনের স্টেশন কমান্ডার মাজিদের সঙ্গে। তিনি বলেন,

মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেককেই সহায়তা করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিও এগিয়ে এসেছেন। হয়তো তাদের ক্ষতির তুলনায় তা কম হতে পারে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা ছিল সর্বোচ্চ সহায়তা করার।

মাছ ধরা ও ভ্রমণ নিষিদ্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই এ সময়টাতে পর্যটক ভ্রমণ ও সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। তবে মোখার পরপরই এটা হওয়ায় মানুষ কিছুটা বিপদে পড়েছেন এটা ঠিক। তবে আর কিছুদিন পরেই মাছ ধরতে যেতে পারবেন জেলেরা। তখন আশা করি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে জীবন যাত্রার মান।’

গত ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাতহানে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এ দ্বীপটি। ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সারা দেশে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ। এতে প্রাণহানি না ঘটলেও সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১২০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। গাছপালা উপড়ে পুরো দ্বীপ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কক্সবাজার জেলায় সাড়ে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েকশ ঘরবাড়ি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়।

মোখার আঘাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অনেক অঞ্চল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সিতওয়ে অঞ্চলের বহু ঘরবাড়ি পানিতে প্লাবিত হয় এবং অনেক কাঠের বাড়ি ভেঙে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় মোখার ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, মিয়ানমারের রাখাইনে মোখার প্রভাবে অন্তত ৪৬৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৫ জুলাই ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]