শুক্রবার ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত সেই জেলা রেজিস্ট্রার ফজলারের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হয়রানির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৩ | প্রিন্ট

দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত বাগেরহাটের জেলা রেজিস্ট্রার ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার আশ্বাসে এক নারীকে বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ ও ভুক্তভোগীর স্কুলশিক্ষিকা বোনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ প্রেসক্লাবে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করে ভুক্তভোগী পরিবার।

অভিযুক্ত ফজলার রহমান ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার কুচিয়াগ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান মোল্লার ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ধর্ষণের শিকার নারীর স্কুলশিক্ষিকা বোন। তিনি জানান, দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত জেলা রেজিস্ট্রার ফজলার রহমান তাঁর বোনকে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে চাকরি দেওয়ার আশ্বাসে তাঁর বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করাতে থাকেন। বিপত্নীক ফজলুর রহমান এক পর্যায়ে তাঁর বোনকে ধর্ষণ করেন। পরে বিয়ের আশ্বাসে তাঁর বোনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এভাবে বাড়িতে কয়েক বছর আটকে রেখে ভুক্তভোগীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যান। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তিনি ভুক্তভোগীকে বিয়ে বা চাকরি প্রদান কোনোটিই করেননি।

এক পর্যায়ে ফজলারের ছলচাতুরির বিষয়টি বুঝতে পেরে তাঁর বোন নিরুপায় হয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসেন। পরে পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে তিনি উদ্যোগী হয়ে তাঁর বোনকে অন্যত্র বিয়ে দেন। বিষয়টি জানতে পেরে ফজলার ক্ষিপ্ত হন এবং তাঁকে (স্কুলশিক্ষিকা) একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়াতে থাকেন। একটি সিআর মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করালে তিনি ৫ দিন কারাগারে ছিলেন। যার কারণে তিনি চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও হন।

এতেও ক্ষান্ত না হয়ে ফজলার তাঁর বিরুদ্ধে বিবিধ বিষয় নিয়ে থানায় ও আদালতে একাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় ফজলার তার আপন ফুফাতো ভাই নুরুজ্জামান মোল্লাকেও আসামি করে হয়রানি করছেন। এভাবে তাঁকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানির কারণে তিনি নাবালক সন্তান ও পরিবার নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি ফজলার রহমানের দায়ের করা এসব মিথ্যা মামলাগুলো থেকে তাঁকে রক্ষায় প্রশাসনের কাছে আইনি সহায়তার কামনা করেন।

ভুক্তভোগী স্কুলশিক্ষিকা বলেন, ফজলার রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোট ৭টি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলার মধ্যে ফজলার ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার থাকাকালীন দুর্নীতির দায়ে ৬টি ও ফরিদপুরে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাকরিচ্যুত বাগেরহাট জেলা রেজিস্ট্রার মো. ফজলার রহমানের ব্যক্তিগত নম্বরে কল দেওয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে আবারও কল দেওয়া হলে তিনি ব্যস্ত আছেন এবং এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।

দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হন ফজলার

২০১৩ সালে ময়মনসিংহ জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ফজলার রহমান ভালুকা উপজেলার বনবিভাগের মালিকানাধীন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৯.৬৪ একর জমির ভুয়া জমিদাতা, শনাক্তকারী ও দলিল লেখক সাজিয়ে এনটিভি ও রোজা এগ্রো লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালুর কাছে ছয়টি দলিলমূলে এক কোটি ২৭ লাখ টাকা মূল্যে রেজিস্ট্রি করে দেন। মোসাদ্দেক আলী ফালু এই জমিটি তার রোজা এগ্রো লিমিটেডের নামে কিনেছেন। ফজলার রহমান এই কাজে স্থানীয় জমির ভুয়া মালিক, দলিল লেখক ও শনাক্তকারী হিসেবে মোট ১১ ব্যক্তিকে রেখেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুদক তদন্তে নামে। প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা মেলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে জেলা রেজিস্ট্রার ফজলার রহমানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করতে অনুমতি চাওয়া হয়। তারপর কমিশন মামলা করার অনুমতি দিলে ভালুকা থানায় পৃথক ছয়টি মামলা করা হয়। প্রত্যেকটি মামলায় প্রধান আসামি ফজলার। তারপর ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর সোমবার বাগেরহাট শহরের জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে ফজলার রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে আদালতের মাধ্যমে বাগেরহাট জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে এসব দুর্নীতির দায়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ফজলার

দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে ফজলুল রহমানের রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তার সম্পদের পরিমাণ দেখে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি নিজের নামে এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে দেশের বিভিন্ন জেলায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নে প্রাসাদসম একটি বাড়ি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলফাডাঙ্গা বাজারের দক্ষিণ পাশে বাকাইল রোডে তার জমি রয়েছে নয় শতাংশ। আলফাডাঙ্গা বাজারে আকরাম চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে তিন শতাংশ জমি রয়েছে।

বুড়াইচ ইউনিয়নের কোটরাকান্দি মৌজায় ফসলি জমি কেনা আছে ছেলে ফয়সাল রহমান, পিয়াস রহমান, মিজানুর রহমান, ফজলার রহমানের বোন মিনার নামে জমি কেনা আছে। ওই এলাকায় সাড়ে সাত একর জমি কেনা আছে। গোপালপুর ইউনিয়নের টেগরডাঙ্গা, কাতলাসুর, পবনবেগ, কুচিয়াগ্রাম গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ৩০ একর ফসলি জমি কেনা আছে। এগুলো তার মামাতো ভাই নুরুজ্জামান, ভাই কুতুবউদ্দিন, ছেলে ফয়সাল রহমান, পিয়াস রহমান, মিজানুর রহমান, ফজলার রহমানের বোন মিনা, খালাত ভাই আবুল কাশেমের নামে কেনা।

কুচিয়াগ্রামের উত্তরপাড়ায় তিনতলা বাড়ি করেছেন ফজলুর রহমান। বিলাসবহুল প্রাসাদ। আনুমানিক খরচ করেছেন পাঁচ কোটি টাকা। কুচিয়াগ্রাম জয়বাংলা হাটের ওপর মসজিদ এবং মাদরাসা করেছেন প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে। বাগেরহাটের সদর উপজেলার রাধাবল্লব গ্রামে ৩০ একর জমি নিয়ে চিংড়ির একাধিক ঘের করেছেন। ওখানে প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। রাধাবল্লব এলাকাতে তিনি বাড়ি এবং জুটমিল করছেন। জুটমিল করছেন আনুমানিক সাত একর জমি নিয়ে। মাটি ভরাট করা হয়েছে। বর্তমানে নির্মাণ কাজ চলছে। ওখানে বর্তমানে একটি টিনসেডের বিশাল ঘর তুলেছেন। নাম দিয়েছেন বাগান বাড়ি।

বাগেরহাট সদরেও তার জমি আছে। বাগেরহাটের জমিগুলো মামাতো ভাই নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের নামে কেনা। পিরোজপুর সদরে লুৎফর মিয়ার ইটের ভাটার ভেতরে তার নামে জমি আছে। এছাড়া ঘেরও আছে ওই এলাকায়। ওখানে সব মিলিয়ে তিন একর জমির মালিক তিনি। পিরোজপুরের জমি মামাতো ভাই নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের নামে কেনা। বরিশালের অনেক জায়গাতে জমি কেনা আছে তার।

কক্সবাজারে আছে তিনটি ফ্ল্যাট। এছাড়া হোটেল কক্সটুডেতে একটি ফ্লোরের মালিক তিনি। কক্সবাজারে বেশকিছু জমিও কেনা আছে। এই সম্পত্তিগুলো নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের নামে কেনা। এসব সম্পত্তির দেখাশোনা করেন কক্সবাজারের সাব রেজিস্ট্রি অফিসের নাইটগার্ড বাবলা।

কুয়াকাটার রাঙাবালি উপজেলায় একশ একর জমি কিনেছেন ফজলার রহমান। সরকারি বন, পাহাড়ের পাশে। কুয়াকাটায় একটি বাড়িও করেছেন তিনি। কুয়াকাটার সম্পত্তিগুলো নুরুজ্জামান ও মনিরুজ্জানের নামেই কেনা। নুরুজ্জামান একসময় সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন। আরো প্রায় ২০ আগে তিনি অবসরে গেছেন। মনিরুজ্জামান পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করতেন। এখন বেকার। তবে বাগেরহাটের জুট মিল দেখা শোনা করছেন।

খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা স্ট্যান্ডের পাশে চার বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। এই জমিগুলো তিনি এবং তার স্ত্রীর নামে কেনা। আনুমানিক প্রতি শতাংশের মূল্য ৫০ লাখের কাছাকাছি।

ফরিদপুর জেলায় যেসব সম্পত্তি করেছেন তার মধ্যে রয়েছে শহরের রাজবাড়ি রাস্তার মোড় থেকে (ঢাকার দিকে যেতে) কিছুটা দুরে ৪০/ ৫০ শতাংশ জমি।যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রতি শতাংশ এক লাখ টাকার বেশি। ফরিদপুর শহরের অন্যান্য জায়গাতেও জমি আছে। এছাড়া ঢাকায় ধানমন্ডির ৪/এ-তে ফ্ল্যাট আছে তার। মামাতো ভাই বিপুলের নামে কেনা।

ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে শেলটেকের বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাট আছে ফ্ল্যাট, নম্বর ৪ জি। তাছাড়া সাভার, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম রোডে শানারপাড় এলাকাতে ১২ কাঠা জমি কিনেছেন তিনি। নতুন অনুমোদিত ৩০০ ফিট বিশ্বরোডের পাশে। জমিটি তিনি অথবা তার প্রয়াত স্ত্রী পাপিয়ার নামে। ঢাকার মধুমতি মডেল টাউন এলাকায় তার জমি আছে। কেরাণীগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের ভালুকাতেও বিপুল ভূসম্পত্তি কেনা আছে তার।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]