নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট
ষাটোর্ধ্ব মো. কালা মিয়া। জীবিকার প্রয়োজনে বাঁশ বেত দিয়ে তৈরি করছেন ঝুঁড়ি, চাই, চালন, কুলা, মাটি কাটার উড়াসহ গৃহস্থালির নানা প্রকার পণ্য। তৈরি করা এসব পণ্য রশি দিয়ে বেঁধে বাঁশের অংশ বা ফালি কাধে রেখে পায়ে হেঁটে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বিক্রি করছেন। নানা প্রতিকূলতা অপেক্ষা করে জীবন সংগ্রামে হাসি-মুখে টানা ৩০ বছর ধরে তিনি এসব বিক্রি করছেন। পণ্য বিক্রি করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে চলছে সংসার।
কালা মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের তারাগন এলাকার বাসিন্দা। যেখানে জীবিকার প্রয়োজনে একেক জন মানুষ একেক রকমের কাজ করছেন। অনেকে কাজ করে সফলতা পেয়েছেন কেউ বা সফলতার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এরইমধ্যে তিনি বাঁশ বেত দিয়ে নানা প্রকারের পণ্য তৈরি করে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখে পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন।
মো. কালা মিয়া বলেন, এক সময় বাবা বাঁশ বেতের নানা প্রকারের পণ্য তৈরির কাজে জড়িত ছিলেন। নিঁখুতভাবে করতেন পণ্য তৈরির কাজ। তাতেই চলতো আমাদের সংসার। শখের বশে ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে থেকে আমার এ কাজ শেখা হয়। কিন্তু পেশা হিসেবে এ কাজ করা হয়নি। বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। নানা কারণে বাবার সামান্য আয়ে সংসার চলা কঠিন হয়ে পড়ায় মা, ভাই, স্ত্রী, পুত্র, ছেলে মেয়ে নিয়ে জীবন নির্বাহ করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। সংসারের হাল ধরতে ওই পেশায় না গিয়ে রিকশা চালানো শুরু করি। রিকশা চালানো কষ্টকর হওয়ায় এক পর্যায়ে চালানো বন্ধ করে দেই। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে বাবার কাছ থেকে শেখানো পেশা বাঁশ বেত দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরির সিদ্ধান্ত নেই। এরপর বাঁশ ক্রয় করে বাড়িতে বসে শুরু করি ঝুঁড়ি, ধান চাল রাখার গোলা, চালন, কুলাসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী তৈরির কাজ। তৈরিকৃত ওইসব পণ্যগুলো বিক্রিতে ভালো আয় হওয়ায় আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নানা প্রতিকূলতা অপেক্ষা করে জীবন সংগ্রামে হাসি-মুখে টানা ৩০ বছর ধরে ওইসব বিক্রি করছি।
কালা মিয়া আরো বলেন, আমার সংসারে স্ত্রীসহ ২ ছেলে ৩ মেয়ে রয়েছে। এরইমধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এক ছেলে পড়াশুনা করছে। আমার স্ত্রী কাজের ফাঁকে এ কাজে সার্বিকভাবে সহায়তা করছেন।
কালা মিয়া বলেন, একটি বাঁশ দিয়ে ৬-৭ টি ঝুঁড়ি তৈরি করা যায়। প্রতিদিন ৭-৮ ঝুঁড়ি তৈরি করা হয়। এক একটি ঝুঁড়ি দেড়শ থেকে ২শ টাকা বিক্রি হয়। আর উড়া বিক্রি হয় ১শ টাকায়। স্থানীয় পর্যায়ে বাঁশ বেতের তৈরি সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা আছে। প্রতিদিন সকালে বাঁশ বেতের তৈরি ওইসব পণ্য নিয়ে পায়ে হেটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করছি। তারপর দুপুর ১২টার দিকে বাড়িতে চলে আসি। খাওয়া দাওয়ার পর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে উঠানে বসে শুরু করা হয় ওইসব পণ্য তৈরির কাজ।
বাঁশের তৈরি পণ্য তৈরি করতে প্রথমে বাঁশ সংগ্রহ করতে হয়। এরপর বাঁশ কেটে ফালি করে রোদে শুকানোর পর বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরি করা হয়। ওইসব পণ্যের মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে বেশ পরিচিতি রয়েছে। অনেকে আবার নানা জাতের পণ্য তৈরির জন্য অগ্রিম বলে যায়। ওই সব বিক্রি করে প্রতি মাসে যাবতীয় খরচ বাদে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা আয় হয়। এতেই চলে আমার সংসার। বর্তমানে সংসারে কোনো অভাব অনটন নেই। আর এই ব্যবসা করেই মরতে চাই।
পৌর শহরের দেবগ্রাম এলাকার গৃহিণী রিনা বেগম বলেন, গৃহস্থের বাড়িতে উড়া ঝুঁড়ি, গোলা, চালনসহ অন্যান্য পণ্য প্রয়োজন হয়। গত কয়েক বছর ধরে ওইসব পণ্য আমরা ঐ লোকের কাছ থেকে ক্রয় করছি। তার হাতের তৈরি ওইসব পণ্যের কাজ অনেক ভালো।
মো. সাব্বির হোসেন বলেন, বাঁশ বেতের ঝুঁড়ি, ধান চাল রাখার গোলা, চালন, কুলাসহ বিভিন্ন পণ্য প্রতিটি বাড়িতে কম বেশি প্রয়োজন হয়। বাড়িতে চলছে মাটি কাটার কাজ। তাই কাজ করার জন্য ৩টা উড়া ৩শ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে। বেশিরভাগ সময় প্রয়োজনীয় বাঁশ বেতের পণ্য এই লোকের কাজ থেকে কেনা হয়।
উপজেলা নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সহ-সভাপতি মো. মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁশ বেত শিল্প। গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার এ শিল্পটিকে আজো ধরে রেখেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে বাঁশ বেতের বিভিন্ন পণ্য কিছুটা প্রভাব পড়লেও এখনো যেন সৌখিন মানুষের কাছে ওই সব পণ্যের চাহিদার কোনো কমতি নেই। এর মধ্যে কালা মিয়া দীর্ঘ বছর ধরে এ পেশায় কাজ করে জীবিকা অর্জন করছেন। আমি মনে করি সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলে বাঁশ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
Posted ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪
ajkerograbani.com | Salah Uddin