সোমবার ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষুধা পেলে লিখতে বসেন আবু তালেব

নিজস্ব প্রতিবেদক:   |   শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট

ক্ষুধা পেলে লিখতে বসেন আবু তালেব

যারা রমনা হয়ে মৎস্য ভবন দিয়ে হেঁটে হেঁটে শিল্পকলা যান, তাদের কাছে মৎস্য ভবনের ফুটওভার ব্রিজটি সুপরিচিত। এই ওভারব্রিজের ওপরই দেখা হয় আবু তালেবের।

আট মাস আগে নোয়াখালী থেকে আবু তালেব ঢাকা এসেছেন। ঢাকায় তার নেই থাকা কিংবা খাওয়ার জায়গা। বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাজও করতে পারেন না।

আবু তালেবের সঙ্গে যখন দেখা, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার পথে। ফুট ওভারব্রিজের ওপর একজন মানুষ কতগুলো সাদা কাগজ নিয়ে নুয়ে নুয়ে একমনে লিখে যাচ্ছেন। আগ্রহ নিয়ে থামতেই দেখা গেল, আবু তালেব উপন্যাস গোছের কিছু একটা লিখছেন। পাশেই পড়ে আছে আকাশি রঙের একটি প্লাস্টিকের ফাইল ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে কী–জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, একটি গামছা, একটি গেঞ্জি ও কাগজ-কলম।

এখানে বসে এভাবে কেন লিখছেন–জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, ‘ভেবেছিলাম ঢাকায় এসে কোনো একটা কাজ জোগাড় করে ফেলব। কিন্তু গতর খাটানো ছাড়া আর কোনো কাজ পাইনি। এখন যে বয়স তাতে তো আর ইট-বালু টানা যায় না। ভিক্ষা করাটাও স্বভাবে নেই। একটা সময় মনে হলো গ্রামে ফিরে যাই। কিন্তু গিয়ে কী করব! তিনটি মেয়ে ও এক ছেলের অভাবের সংসার। আমি কাজ ছাড়া ফিরে গেলে বাড়তি আরেক বোঝা।’

এতকিছু করার থাকতে লেখালিখি কেন–জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, ‘লিখে আমার সময় কাটে। শুরুতে খুব খারাপ লাগত। কোথায় যাব, কী খাব–এসব ভাবতে ভাবতে হতাশ হয়ে পড়তাম। একটা সময় এত এত দুঃখের মধ্যে মনে হলো লেখি কিছু একটা। যা ইচ্ছা হয় লিখি। একজনের কাছ থেকে কাগজ-কলম কেনার টাকা চেয়ে নিলাম। এরপর লেখা শুরু করলাম। এমনিতে আমি ক্লাস এইট পাস। এখন খাবার পেলে খাই, না পেলে খাই না। ক্ষুধা পেলে লিখতে বসি, লিখতে বসলে ক্ষুধা ভুলে যাই।’

ক্ষুধাকে কীভাবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার ওপর ফ্রানৎস কাফকার একটি ছোটগল্প ছিল ‘ক্ষুধার্ত শিল্পী’ নামে। আবু তালেবকে দেখে কোনো অংশেই সেই শিল্পীর থেকে কম মনে হলো না, যে পেটে ক্ষুধা নিয়ে নিজের মনে লিখে যাচ্ছেন।

কী লিখছেন জিজ্ঞেস করতে তালেব বলেন, ‘একটা উপন্যাস লিখছি। এখানে প্রেম আছে, কষ্ট আছে, ক্ষুধা আছে। কল্পনায় যা আসছে তা-ই লিখছি।’

না খেয়ে থাকা কোনোভাবে লেখায় প্রভাব ফেলছে কি না–জানতে চাইলে তালেব বলেন, ‘ক্ষুধার কষ্ট বুঝতে হলে, লেখায় তার ছবি আঁকতে হলে আপনাকেও ক্ষুধার্থ থাকতে হবে। এই যে দিনের পর দিন অনাহারে থাকছি আমি–খাবার পেলে খাচ্ছি, না পেলে উপোস থাকছি–আমার গল্পের চরিত্রগুলোকে আমি এভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি। পেটভরে খেলে তো বোঝা যাবে না কষ্টটা। আর কষ্টটা বুঝতে না পারলে ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে আপনি!’

আবু তালেবই প্রথম নন, যিনি এমন কথা বলেছেন। লেখালিখি নিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি যা লিখছ, তা তোমার অভিজ্ঞানলব্ধ হতে হবে। বানিয়ে বানিয়ে তো মিথ্যে কথা লেখা যায় না। অনুভব করতে না পারলে লেখায় যথার্থতা আসে না।’ ক্ষুধার কষ্ট বুঝতে একবার বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান লেখক আহমেদ ছফা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি না খেয়ে ছিলেন। পরে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। আবু তালেব তার চিমশে যাওয়া পেট দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই আমি।’

গ্রামে কবে ফিরে যাবেন–জিজ্ঞেস করতেই তালেব বলেন, ‘যাব। ওদের (পরিবার) কথা অনেক মনে পড়ে। প্রতিদিনই মনে হয় চলে যাব। যাব যে যাওয়ার টাকাই তো নেই। চলে যাব হুট করে একদিন।’

কিছু খাবেন কি না–জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, ‘কয়েকটি কাগজ কিনে দেন। লিখি আরও কিছুক্ষণ।’

আলাপচারিতায় ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। আবু তালেবের থেকে বিদায় নিয়ে একবার পেছনে তাকাতে দেখা গেল, গোধূলির ম্লান আলোয় একজন ক্ষুধার্ত লেখক লিখে যাচ্ছেন, যার একটি লেখাও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। লেখা প্রকাশ করা নিয়ে যার মাথাব্যথা নেই। ক্ষুধা ভুলতে লিখতে বসে আবু তালেব লেখার প্রেমে পড়েছেন।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৩:১১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০  
সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]