রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুজিব আসিবে ফিরে

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট

মুজিব আসিবে ফিরে

২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঘড়িতে সময় তখন রাত ১টা বেজে ৮ মিনিট। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তান নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তোলে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একটি বিশেষ কমান্ডো ইউনিটের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের নিশ্চিত তথ্য জানাতে পাকিস্তানি হাইকমান্ডকে পাঠানো বিশেষ বার্তায় বলা হয় ‘বিগ বার্ড ইন দ্য কেজ’।

এরপর আবার একদিন বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় মাতৃভূমির বুকে ফিরে আসবেন, তা কেউ ভাবেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ কথা লিখেছেন। যখনই এ কথা ভাবতেন তখনই মর্মপীড়ায় ব্যাকুল হতেন। মৃত্যুর ভয় তিনি করেননি। শুধু একটাই আক্ষেপ ছিল তার- বাঙালির মুক্তি হয়তো তিনি দেখে মরতে পারবেন না। আর কোনোদিন তার মাতৃভূমির মুখ দেখা হবে না। জীবিত দেশে ফেরার সব পথ যখন রুদ্ধ হয়ে আসছিল, তখন তিনি বলেছিলেন মৃত্যুর পর তার লাশটা যেন বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

শেষ পর্যন্ত মুজিব নামের সেই দুরন্ত পক্ষীরাজ ঠিকই আকাশে ডানা মেলেছিলেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। ফিরে ছিলেন আপন নীড়ে। তাকে চিনতে ভুল করেছিল শোষকেরা। সামান্য একটা চঞ্চল পাখি ভেবে তারা খাচায় বন্দি করে ভয় দেখাতে চেয়েছিল যাকে, আসলে তিনি ছিলেন জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড ভেদ করে প্রবল পরাক্রমে জেগে ওঠা এক ফিনিক্স। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকেরা যখন সেটা বুঝতে পেরেছিল, ততক্ষণে তারা পরাজিত।

বঙ্গবন্ধুকে সে রাতে গ্রেফতার করা হয়েছিল বাঙালির আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরাতে। বাঙালির বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে তারা চেয়ে ছিল বাংলাদেশকে পরাস্ত করতে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি শোষকগোষ্ঠির। গ্রেফতারের আগমুহূর্তে ছেড়া কাগজে লেখা চিরকুটে জাতির উদ্দেশে যে বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন মুজিব তা প্রতিটি বাঙালি সত্তাকে জাগ্রত করেছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল, এই চিরকুট ছিল বাঙালির কাছে তার মহান নেতার শেষ বার্তা। বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে দেওয়া মানুষটার শেষ চাওয়া ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

মুক্ত মুজিবের চেয়ে শক্তিমান সত্তা হয়ে আবির্ভুত হয়েছিলেন বন্দি বঙ্গবন্ধু। চিরকুটে লেখা বোবা শব্দগুলো বঙ্গবন্ধুর শত্রুবিনাশী রণহুঙ্কার ও মহামুক্তির বেদমন্ত্র হয়ে বাঙালির বুকে প্রলয় জাগিয়েছিল। ফিনিক্স বন্দি থাকলেও তার ডানার ঝাপ্টায় সেই প্রলয়ের বান থেমে থাকেনি। প্রবল প্রবাহে তা ধসিয়ে দিয়েছিল দুঃশাসনের লঙ্কা।

এরপর সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাংলা মায়ের বুকে ফিরে এসেছিলেন খোকারূপী বঙ্গবন্ধু। বন্দি খাঁচার বেসাত ভেঙে নীড়ে ফিরেছিলেন পক্ষীরাজের বেশে। মাঝরাত্রির মৃত্যু পরোয়ানার পরোয়া না করে, ঠোঁটে ঝোলানো পাইপের কোটরে পোড়া সুগন্ধি তামাকের ধোঁয়ায় মৃত্যুর ভয় উড়িয়ে দিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন স্বচক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার বাঙালির মুক্তির উজ্জ্বাস দেখবেন বলে। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু পা রেখেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার মাটিতে। তার প্রথম পদস্পর্শে সত্যায়িত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

ইতিহাস বলে ঐ একবারই ঘটেছিল সে ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক লগ্ন এসেছিল একবারই। আসলেই কি তাই? হয়তো ইতিহাস সেটা দেখেছিল ঐ একবার। বাংলার বুকে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন ঘটে বারবার। প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে। বাঙালির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে উত্তরণের পথ হয়ে মাতৃভূমির বুকে মুজিবের প্রত্যাবর্তন ঘটে। নষ্টের গ্রাস হতে ধরিত্রী জননীর সম্ভ্রম রক্ষায় কালে কালে যেমন দুষ্টের নাশে অর্জুন অবতারে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি সংকটে বাঙালির সাহস হয়ে, প্রতিটি প্রাপ্তিতে উদযাপনের লগ্ন হয়ে, প্রতিটি অর্জনে বিজয়ের ধ্বনি হয়ে, উদ্ভাবনের উৎসারণে ফিরে ফিরে আসেন মুজিব।

বাঙালির প্রতিটি পার্বন কিংবা শহিদ বেদীতে সাজানো প্রদীপের আলোয় বাঙালির বঙ্গবন্ধু হাসবে। প্রজন্মের প্রবাহনে, বীর বাঙালির গর্বিত সত্তায়, দেশের তরে দেওয়া বাঙালির প্রতিটি উৎসর্গে-কাল হতে কালান্তরে মুজিব ফিরে ফিরে আসবে। এই পৃথিবীর যেই প্রান্তে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে সেখানেই উদ্ভাসিত হবে বাঙালির বঙ্গবন্ধু। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী প্রতিবাদে, শোষিতের হয়ে শোষকের সংহারে মুজিবের প্রত্যাবর্তন চিরন্তন।

বাংলা, বাঙালি আর বঙ্গবন্ধু চিরায়ত বন্ধনে গাঁথা এক পরম সত্তা। নাম তার বাংলাদেশ। যতকাল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ জেগে থাকবে, ততকাল তার বুকে জাগ্রত মুজিবের প্রত্যাবর্তন ঘটবে। বাঙালির মুক্তির মহাকাব্যে, জাগ্রত জাতিসত্তায়, লাল-সবুজের পাতাকায়, রক্তে কেনা মানচিত্রে, লক্ষ বীরের রুধির অঞ্জলিতে আর দৃপ্ত মুষ্টির বিচ্ছুরণের তালে বজ্রকণ্ঠে দেওয়া প্রতিটি জয় বাংলা স্লোগানে- আমার মুজিব চিরঞ্জীব।

এস এম সাব্বির খান: কবি ও সহ-সম্পাদক, দৈনিক সমকাল

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৪

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]