নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির একটি রোগ। তাই ৪১ বছর আগে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পালন করা দূরে থাক উপরন্তু বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হয়নি বলে সে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে গ্লানিময় কণ্ঠে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ কখনও পরাভব মানেনি। তাই স্বদেশী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চার দশক পর হলেও অব্যাহত রেখেছে। এবার পাকিস্তানী সেই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রতীকী হলেও শুরু করছে। বিশ্ব জনমত আজ হোক, কাল হোক, এদের বিচারের জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেবেই।
স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেলেও প্রশ্ন ওঠে এখনও, কেন ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলো না। বিচার ছাড়াই তাদের কেন পাকিস্তানীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হলো। কেন পাকিস্তান প্রতিশ্রুতি দিয়েও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পদক্ষেপ নেয়নি। আটকেপড়া বাঙালীরা পাকিস্তান হতে ফেরত এলেও বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানীরা এখনও কেন পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করছে না। প্রশ্ন যখন আছে, উত্তরও তার রয়েছে দণ্ডায়মান। কেন, কী কারণে যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি পেল, তার নেপথ্যে ঘটনার ঘনঘটা কম নয়।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার সেনাদের আত্মসমর্পণ পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত— এই তিন দেশের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক টানাপোড়েন শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়। ভারত এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই সমর্থন করে। কিন্তু ভারতের তখন তাদের আশ্রিত প্রায় এক লাখ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর ভরণ-পোষণ নিয়ে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। বাংলাদেশও আটকেপড়া পাকিস্তানীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পক্ষে তাদের ভরণ-পোষণও অসম্ভব হয়ে ওঠে। যদিও এরা তখন থেকেই জেনেভা কনভেনশনের অধীনে। যেমন ছিল পাকিস্তানী সেনারা। ভারত যেহেতু আন্তর্জাতিক জেনেভা কনভেনশনের সদস্য এবং যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, তাই যুদ্ধবন্দীদের রক্ষা করার জন্য দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ। যে কারণে পাকিস্তানী হানাদাররা বাঙালি মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে আগ্রহী হয়নি। হলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মর্যাদা পেত না। যদিও যৌথ বা মিত্রবাহিনীর কাছে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু দলিলে মিত্র বাহিনীর বাঙালি পক্ষের স্বাক্ষর নেই। তবে পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য যে আহ্বান জানানো হয়েছিল, তাতে যৌথবাহিনীর কথা উল্লেখ ছিল। আত্মসমর্পণ দলিলেও বলা হয়, ‘আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করা হবে এবং আত্মসমর্পণকারী সকল পাকিস্তানী সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’ এতে হানাদারদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আলশামস ও আলবদররা জেনেভা কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এদের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের হাতে ন্যস্ত বলে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছিলেন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ভারতে স্থানান্তর কালে।
যুদ্ধবন্দীদের যাতে বিচার হতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তান তখন ‘তুরুপের তাস’ হিসেবে সে দেশে আটকে পড়া ৪ লাখ বাঙালীকে জিম্মি করার হুমকি দেয়। যুদ্ধবন্দীদের দ্রুত পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর জন্য জাতিসংঘসহ মুসলিম দেশগুলো ভারত ও বাংলাদেশকে চাপ দিতে থাকে। একাত্তরের সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে তখন শুরু হয় তিন দেশের মধ্যে কূটনৈতিক লড়াই এবং তাতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশই প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটাকে সামনে নিয়ে আসে।
মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একেএম কামরুজ্জামান ১৯৭১-এর ২৭ ডিসেম্বরে ঘোষণা দেন যে, ‘বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৩০ জন শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে এবং গণহত্যায় সহযোগিতার জন্য অচিরেই তাদের বিচার হবে।’ এরপরই একাত্তরে গণহত্যার শিকার সাত বাংলাদেশী কর্মকর্তার পরিবারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে দোষী পাকিস্তানীদের বিচারে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য আবেদন জানিয়ে কলকাতায় সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য ডিপি ধর বলেন, ‘ভারত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন পরীক্ষা করছে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই ভারত স্পষ্ট ঘোষণা দেয় যে, ‘যুদ্ধাপরাধী বিচারের ব্যাপারটি বাংলাদেশের এখতিয়ারের ভেতর। কারণ পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে। ফলে এ নিয়ে ভারতের একার বলার বা সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছু নেই। যা কিছু করতে হয় তা বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার ভিত্তিতেই করতে হবে।’ বাংলাদেশ সরকারও ঘোষণা দেয় যে, ‘কূটনৈতিক স্বীকৃতির আগে এবং সম্পর্কের সমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে এ নিয়ে কোন কথা বলতে সে প্রস্তুত নয়। আর ১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বরে ক্ষমতায় বসে ভুট্টো দেখলেন, তার ক্ষমতা ধরে রাখা সহজ নয়। ‘জাতশত্রু’ ভারতের কাছে হেরে এবং আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের তখন করুণ দশা। ভুট্টো জাতিসংঘে দাবি তোলে ভারতকে দ্রুত তার ৯৩ হাজার সেনাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন গোঁ ধরে বসে আছে; যুদ্ধাপরাধের জন্য তারা পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করবে। সে উদ্দেশ্যে যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের এক তালিকাও বাংলাদেশ তৈরি করে। ভুট্টোর জন্য তখন প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল সে বিচার ঠেকানো এবং যুদ্ধাপরাধীসহ সব বন্দীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়া। ভুট্টোর জন্য এই এজেন্ডা পাকিস্তানী জেনারেলরা ঠিক করে দেয় ক্ষমতায় বসার প্রথম দিন থেকেই। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন সে সময় ছিল পাকিস্তানের বিবেচনার বাইরে বরং যেসব দেশ বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের সঙ্গে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখবে না বলে পাকিস্তান ঘোষণা দেয়। তাই দেখা যায়, ১৯৭২-এর প্রথম দিকে ছোট ছোট গোটা কয়েক দেশের সঙ্গে পাকিস্তান তার সম্পর্ক ছেদও করে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করায় যুক্তরাজ্যের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকেও বেরিয়ে আসে।
’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। সে অনুযায়ী বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার বাহাত্তরের ২৯ মার্চ ঘোষণা করে যে, জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলীসহ ১১০০ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে। সেজন্য একটি প্রস্তাবনাও উপস্থাপন করা হয়। যাতে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচারে দেশি-বিদেশি জুরি নিয়োগ এবং অন্যদের জন্য শুধু দেশীয় জুরি নিয়োগের উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সেসব পাকিস্তানী সেনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিকভাবে প্রমাণের ভিত্তিতে ‘প্রাইমা ফেসিইকেল’ যোগ করতে পারবে। বাংলাদেশের সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ১৪ জুন ভারত সরকার নিয়াজীসহ প্রাথমিকভাবে ১৫০ যুদ্ধবন্দীকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ জুন বঙ্গবন্ধু পুনরায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলার মাটিতেই তাদের বিচার হবে।
১৯৭২ সালের ২৮ জুন থেকে ৩ জুলাই ভারতের শৈলশহর সিমলায় অনুষ্ঠিত হয় ইন্দিরা-ভুট্টো বৈঠক। ভুট্টোকন্যা ১৮ বছর বয়সী বেনজীরও এই সময় উপস্থিত ছিলেন। এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে ইন্দিরা তাদের অভ্যর্থনা জানান। প্রথমে ইন্দিরা ও ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক হয় অন্য কোনো উপদেষ্টা বা পরামর্শক ছাড়াই। এরপর উভয় সরকারের উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতাদের উপস্থিতিতে ইন্দিরা ভুট্টোর মধ্যে আরও কয়েক দফা বৈঠক হয়। অতঃপর দুই দেশের মধ্যে অতীতের সমস্ত সংঘর্ষ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের অবসান ঘটিয়ে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সঙ্কল্প ব্যক্ত করে ইন্দিরা ও ভুট্টো এক চুক্তি সই করেন। এটাই ‘সিমলা চুক্তি’ নামে খ্যাত।
সামরিক ও রাজনৈতিক নানা দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিয়ে বৈঠকে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের স্বীকৃতি বা যুদ্ধবন্দী ফেরত নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। চুক্তিতে কাশ্মীর সীমান্তসহ দ্বিপাক্ষিক কতিপয় বিষয়, যেমন পাকিস্তানের যে অঞ্চল ভারত দখল করেছে, তা ছেড়ে দেয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
সিমলা চুক্তির পর পরই বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন যে, ‘বাংলাদেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।’ প্রতিবাদ জানায় ভুট্টো, ‘পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার করার কোন অধিকার বাংলাদেশের নেই। কারণ পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে।’ তখন ভারত সরকার বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘প্রকৃত সত্য এই যে, পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে। আর সে কারণেই যুদ্ধবন্দীদের প্রশ্নে যে কোন সিদ্ধান্ত ভারত ও বাংলাদেশের মতৈক্যের ভিত্তিতেই গৃহীত হবে।’
যুদ্ধবন্দীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পাকিস্তান সরকার সে দেশে আটকে পড়া ৪ লাখ বাঙালিকে তখন ‘জিম্মি’ করে। বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশকারী সন্দেহে বহুজনকে বন্দীশালায় আটকে রাখে। প্রায় ১৬ হাজার বাঙালী সরকারী কর্মকর্তা, যাদের একাত্তরেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের পাকিস্তান ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সেখানে আটকে পড়া বাঙালিদের পরিবারসহ অমানবিক পরিবেশে বন্দীদশায় রাখে। অনেক বাঙালি আফগানিস্তানের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দেশে আসার পথে মারা যান। যারা আফগানিস্তান হয়ে পালিয়ে আসছিলেন, সেই সব বাঙালিকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ভুট্টো সরকার মাথাপিছু এক হাজার রুপী পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
বাঙালীবিদ্বেষী অনেক পাকিস্তানী অসত্য অভিযোগ এনে প্রতিবেশী অনেক বাঙালিকে পরিবারসহ ধরিয়ে দেয়। যাদের পুলিশী নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি পাকিস্তানে বাঙালিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন পেশ করেছিল। যাতে বলা হয়েছিল, ‘হাজার হাজার বাঙালি বিনা বিচারে জেলে আটক আছে। পাকিস্তান ত্যাগ করতে পারে এই অভিযোগে বাঙালিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিদিনই তাদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং তারা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে যারা উঁচু পদে রয়েছেন এবং বিত্তবান তারা দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে। বাঙালিদের ‘নিগার’ বা নীচুজাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। যারা ইতোমধ্যেই নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার, তাদের প্রতি অত্যন্ত খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীসহ সরকারি উঁচুপদে অনেক বাঙালি পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে চাকরিরত রয়েছেন।’ যেসব বাঙালি নারী বা পুরুষ পাকিস্তানী বিয়ে করেছেন, তাদের অবশিষ্টাংশ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বহাল তবিয়তে সে দেশে রয়ে যায়। ভুট্টো প্রকাশ্য জোর গলায় বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশের প্রস্তাবের বিপরীতে পাকিস্তান আটকে পড়া বাঙালীদের জিম্মি করতে বাধ্য হয়েছে।
আটকে পড়া বাঙালিদের ফেরত আনার জন্য তাদের পরিবার ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। প্রয়োজনে যুদ্ধাপরাধীদের বিনিময়ে তাদের স্বজনদের ফেরত আনার দাবি জানাতে থাকে। এই দাবিতে তারা সমাবেশ এবং অনশন পালন অব্যাহত রাখে। ১৯৭২ সালের ৪ মে ঢাকাজুড়ে জনতার বিক্ষোভ মিছিল বের হয় বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে। সরকারের ওপর তারা ক্রমাগত চাপ বাড়াতে থাকে। আটকে পড়া বাঙালিদের ব্যাপারে বাংলাদেশ তখন বিশ্ব জনমতের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিবের সাহায্য কামনা করে ভারতের মাধ্যমে আবেদন জানায়। অপরদিকে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় নিহত শহিদদের পরিবারগুলো সারাদেশে সভা-সমাবেশ করতে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার দালাল আইন জারি করে। আলবদর, আলশামস, রাজাকারসহ দালালদের গ্রেফতার অব্যাহত রাখে এবং বিচারকাজ শুরু করে। চীনাপন্থী দল, উপদল ও গ্রুপ এবং মওলানা ভাসানী এই আইন বাতিলের দাবি জানাতে থাকেন। তারা এই আইনে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বলে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে হুঁশিয়ারি জারি করে। পাশাপাশি মুজাফফর ন্যাপ, সিপিবিসহ কয়েকটি দল আটকেপড়া পাকিস্তানীদের দ্রুত পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর দাবি তুলতে থাকে। নানামুখী চাপে তখন বঙ্গবন্ধু সরকার।
অপরদিকে ভুট্টো বুঝতে পেরেছেন, আটকে পড়া বাঙালিদের ফেরত নিতে শেখ মুজিবের সরকার চাপের মুখে রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে দেরি না করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে কর্মরত সেনাসদস্য ও চাকরিজীবী কয়েক শ’ বাঙালিকে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ এনে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু তাদের মুক্তি প্রদানের দাবি জানালেও ভুট্টো তাতে সাড়া দেননি বরং আটকে পড়াদের বিনিময়ে সকল যুদ্ধবন্দীকে ফেরত নিতে ষড়যন্ত্র আঁটে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টো বিহারি অধ্যুষিত সিন্ধুপ্রদেশে ‘বিহারি বাঁচাও’ নামে মিছিল সমাবেশ করান এবং আন্তর্জাতিক মহলকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে আবেদন জানালেও বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
১৯৮৯ সালে দিল্লী হতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ এ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওমান এরিয়াস’ গ্রন্থে অধ্যাপক ডেনিস রাইট উল্লেখ করেছিলেন সে সময়ের কথা ‘বিকৃত বিচারের বদলে যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্নটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশের জন্যই একটি ‘কূটনৈতিক তুরুপের তাস’-এ পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ তাকে ব্যবহার করছে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। আর পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে দাবি করছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নাকচ করার জন্য।’
যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানী সেনাদের নিয়েও বিপাকে পড়ে ভারত। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী এদের নিরাপত্তা, খাওয়া-দাওয়াসহ ভরণ-পোষণ এবং ভাতা প্রদান করতে হতো ভারতকেই। এ খাতে প্রতিমাসে ব্যয় দাঁড়াচ্ছিল এক লাখ ডলারের বেশি। যুদ্ধ শেষ, যুদ্ধবিরতি চুক্তিও সই হয়েছে, পরাজিতরা আত্মসমর্পণও করেছে, সুতরাং তাদের আর আটকে রাখার পক্ষে কোনো যুক্তিও ভারতের সামনে তখন ছিল না। ভারত আকাশবাণীর বিশেষ চ্যানেল চালু করে, যেখান থেকে যুদ্ধবন্দীরা পাকিস্তানে তাদের পরিবারের কাছে নিজের অবস্থা জানান দিয়ে বার্তা প্রচার করতে থাকে। তাই দেখা যায়, বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডাইম ভারত সফরে এসে ইন্দিরা গান্ধীকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দেন। ইন্দিরা অবশ্য সরাসরি জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের মতামত অগ্রাহ্য করে ভারত একতরফাভাবে কিছু করতে পারে না, করবেও না। ইন্দিরা জানতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে শেখ মুজিব দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম তালিকায় ১৫০০ পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যের নাম প্রকাশ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যথাযথ তথ্য প্রমাণ হাজির করার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় তালিকা কমিয়ে আনে। শেষে তা দাঁড়ায় ১৯৫ জনে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত বাংলাদেশের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি এই তালিকা করে। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যুদ্ধবন্দী বিষয়ে প্রথম আইন পাস করা হয়।
দিল্লী থেকে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ; সার্চ ফর নিউ রিলেশনশিপ’ গ্রন্থে অধ্যাপক মুহম্মদ আইউব লিখেছেন, ‘ভুট্টো জানতেন, তার দেশের আটক যুদ্ধবন্দী ভারতের জন্য বোঝাস্বরূপ। আজ বা কাল হোক, ভারতকে সব যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দিতেই হবে। ফলে এই প্রশ্নে দেন-দরবার করে কোন বাড়তি ফায়দা আদায় হবে না। ভুট্টো বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও হেনস্থা করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। পুরো ১৯৭২ সাল তাই ভুট্টো বাংলাদেশকে ভারতের অধিকৃত অঞ্চল বলে ঘোষণা করতেন। ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো বলেন, ‘বাংলাদেশ ভেবেছে যে, আমাদের বন্দীদের মুক্ত করার ব্যাপারে তাদের ভেটো ক্ষমতা আছে। ভেটো আমাদের হাতেও একটা আছে।’ ভুট্টো জানান যে, ‘পাকিস্তানের অনুরোধে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিষয়ে ভেটো দেবে।’ সে সময় সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুতরাং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। তাই বাংলাদেশ সাহায্য পাওয়ার জন্য আবেদন করে। ২৫ আগস্ট চীন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিষয়ে ভেটো দেয়। বাংলাদেশের অপরাধ তখন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা। তদুপরি বাংলাদেশ বিচারের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। দূতিয়ালির জন্য বঙ্গবন্ধু চীনেও প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন গোপনে। চীন তখন পাকিস্তানের বিষয়ে অন্ধ এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। ফলে বাংলাদেশের দূতিয়ালি সফল হতে পারেনি। চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল পুরো একাত্তর সালসহ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত।
১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভুট্টো ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন, ‘কয়েক শ’ পাকিস্তানী বন্দীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হলে তার আপত্তি নেই। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ভুট্টো তার মত পরিবর্তন করে বলেন, ‘পাকিস্তানী বন্দীদের বিচার করা হলে সে আটকেপড়া বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ (হু কিল্ড মুজিব, এএল খতিব)। ১৯৭২ সালের নবেম্বরে ভারতে আটক পাকিস্তানী সেনাপরিবারের প্রায় ৬ হাজার সদস্যকে মুক্তি দেয়। বিপরীতে পাকিস্তানও আটকেপড়া ১০ হাজার বাঙালি নারী ও শিশুর একটি দলকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়। কিন্তু পাকিস্তানে আটক অধিকাংশ বাঙালীর কী হবে, সে নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে বাংলাদেশের। যুদ্ধবন্দী ও আটকেপড়া বাঙালিদের বিনিময় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার আড়ালে চাপা পড়ে যেতে থাকে আটকেপড়া পাকিস্তানী তথা বিহারিদের ফেরত যাওয়ার বিষয়টি। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন এদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা দেয়। এরা যেসব ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়, তা জেনেভা ক্যাম্প নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রায় ৬ লাখ বিহারি পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়। এদের একটা অংশ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর দখল করে রেখেছিল। আল শামস বাহিনীর সদস্যও ছিল এরা। ১৯৪৭ সালের পূর্ব হতেই ব্রিটিশদের কূটকৌশলে বিহার থেকে এরা এদেশে আসে রেলসহ অন্যান্য সেক্টরে কাজের জন্য। পাকিস্তান যুগে এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃজনে এরাই প্রধান নৃশংস ভূমিকা রেখেছিল। প্রচণ্ডভাবে বাঙালিবিদ্বেষী বিহারিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় জায়গা জমি দখল করে গোত্রভুক্ত হয়ে থাকত। ১৯৭১ সালের মার্চে এরা বিভিন্ন স্থানে বাঙালির ওপর হামলা চালায়। আর পুরো নয় মাস গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে এরা পাকিস্তান বাহিনীর বিশ্বস্ত হিসেবে নৃশংস হয়ে উঠেছিল। এদের একটি বড় অংশ অর্থাৎ বিত্তবানরা ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তান চলে যায়। দরিদ্র বিহারিরা আর পালানোর পথ পায়নি। পাকিস্তানী হানাদাররাও এদের সঙ্গে নিয়ে যায়নি। এই আটকেপড়ারা পাকিস্তান যাওয়ার জন্য চার দশকেরও বেশি অপেক্ষমাণ।
যুদ্ধাপরাধী বিচারের পথ বন্ধ করতে পাকিস্তানের কূটনৈতিক তৎপরতা এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭৩ সালের ১০ জানুয়ারিতে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় লেখা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ মুজিবকে পরামর্শদান উপলক্ষে জানিয়ে দিয়েছে যে, একটি বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচার করা হলে পাকিস্তানের হতোদ্যম জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে, প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তা সামলাতে পারবে না এবং এর ফলে উপমহাদেশে শান্তি স্থাপন সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রত্যাহারের জন্য এটাই প্রথম বিদেশী চাপ তা নয়, শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন এ ধরনের পরামর্শ দিয়েছে, তাও নয়। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশে গণহত্যায় লিপ্ত, তখন যেসব মুসলিম দেশ এসবেরও প্রতিবাদ করেনি, তারা ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর জন্য গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের ভাগ্যের সঙ্গে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ভাগ্য বিজড়িত হয়ে পড়ে। তখন ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে টানা চারদিনের আলোচনা শেষে বাংলাদেশ ও ভারতে যৌথ ঘোষণায় যুগপৎ প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব রেখে বলে, যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আটক সব নাগরিককে একযোগে নিজ নিজ দেশে পাঠানো হবে। তার আগে তিনটি দেশ নাগরিকদের ৭টি ক্যাটাগরি প্রণয়ন করেছিল। এই তালিকায় আটকেপড়া বাঙালি ও বিহারি ছাড়াও পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাকিস্তান এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেনি। তাই প্রস্তাব আনা হয়, ভারত সেদেশে আটক প্রায় ১০ হাজার বন্দীকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করবে। বিনিময়ে পাকিস্তান সেদেশে আটকে থাকা বাঙালীদের মধ্যে দু’লাখকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এছাড়া বাংলাদেশে আটক প্রায় দু’লাখ ৬৩ হাজার অবাঙালি তথা বিহারিকেও পাকিস্তান ফেরত নেবে। তারপরও বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি হতে সরে আসেনি। এমনকি অভিযুক্ত পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের এই প্রত্যাবাসন প্রস্তাবের বাইরে রাখে। যুগপৎ এই প্রত্যাবাসনে ভুট্টো সায় দিলেও মাত্র ৫০ হাজার বিহারিকে ফেরত নিতে রাজি হয়। তবে ভুট্টো বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সদম্ভে ঘোষণা করে, ‘বাংলাদেশ যদি অভিযুক্ত পাকিস্তানীদের বিচার করে, তাহলে তিনি পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশের নাগরিকদের একই রকম ট্রাইব্যুনালে বিচার করবেন।’ ১৯৭৩ সালের ২৭ মে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ভুট্টো বলেন, ‘বাঙালিদের এখানে বিচার করার দাবি জনগণ করবে। আমরা জানি বাঙালিরা যুদ্ধের সময় তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে। কতজনের বিচার করা হবে, তা এখনই বলতে পারছি না। বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করে, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্যু’র মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সরকারের পতন ঘটাবে এবং দুই দেশের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবে। এই চক্রান্তের জন্য ইতোমধ্যেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।’
ভুট্টোর এসব বাগাড়ম্বরের প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৩ সালের ৭ জুন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভোলা সম্ভব নয়। এই হত্যা, ধর্ষণ, লুটের কথা জানতে হবে। যুদ্ধ শেষের মাত্র তিন দিন আগে তারা আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তারা প্রায় ২ লাখ নারীকে নির্যাতন করেছে, এমনকি ১৩ বছরের মেয়েকেও। আমি এই বিচার প্রতিশোধের জন্য করছি না। আমি এটা করছি মানবতার জন্য। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বাঙালিদের বিচারের হুমকির প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য। এই মানুষগুলো চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা; যারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চায়, ওরা কী অপরাধ করেছে? এটা ভুট্টোর কী ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা।’ কিন্তু ভুট্টোর কুমন্ত্রণা তার আদ্যোপান্ত জীবনজুড়ে। তিনি ষড়যন্ত্রের জাল ছড়াতে থাকেন। পাকিস্তান সে দেশে আটক ১৯৫ শীর্ষ বাঙালী কর্মকর্তাকে বিচারের জন্য গ্রেফতার করে বলে ১৯৭৩ সালের ২৬ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় সফরে যান যুগোশ্লাভাকিয়ায়। এ সময় পাকিস্তানী নোবেল জয়ী পরমাণু বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম এক পত্রে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম ওয়াজেদ মিয়াকে জানান, তিনি বেলগ্রেডে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর একটা বৈঠকের আয়োজন করতে চান। পাকিস্তান তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ায় বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব নাকচ করে দেন। প্রফেসর সালাম বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে পত্রে অনুরোধ জানান, ‘শেখ সাহেবের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ যে, তিনি যেন ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর মধ্যে শুধুমাত্র ১৯৫ কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে বাকিদের বিনা শর্তে মুক্তি দেন। পরবর্তীতে ১৯৫ জনের বিচার করে ওদের থেকে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেয়া যেতে পারে।’ বাংলাদেশ ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস, দালালদের বিচারের জন্য ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’ জারি করে। ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশের নয়া সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। এতে ৪৭(৩) ধারা সংযুক্ত করা হয়। যাতে ‘গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্রবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিত্বে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করার বিধান’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০ জুলাই জারি করা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩। এর ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাদের জন্য পাকিস্তানী সেনা এবং দেশীয় যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদরদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার পথ সহজ হয়।
বাংলাদেশও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অনড় অবস্থানে থাকে। তবে ভারতের শিবিরে থাকা অন্য যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে অনাগ্রহী ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। পাশাপাশি পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের বিপরীতে চীনের অবস্থান ভারতকে বিপাকে ফেলে। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে ভারত তখন আগ্রহী নয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই। আন্তর্জাতিকভাবে যেমন, তেমনি অভ্যন্তরীণভাবেও ইন্দিরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি হতে থাকে। যাতে ভারত দ্রুত সব যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিমলা চুক্তির সূত্র ধরে ভারত-পাকিস্তান দু’দফা বৈঠকে বসে। ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে এবং আগস্টে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইন্দিরার বিশেষ উপদেষ্টা পিএন হাকসার এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি চুক্তি সই হয়। ভারতে আটক থাকা পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালী এবং বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এই লোক বিনিময় শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বাকি ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিষয় চূড়ান্ত করবে। কিন্তু বাংলাদেশকে আলোচনায় না রাখায় দুটি বৈঠকে চুক্তি জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, একমাত্র সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ এ ধরনের কোন আলোচনায় বসতে পারে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই চুক্তি সই হওয়ায় স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, অতঃপর পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু বাস্তবে স্বীকৃতিদান দূরের কথা, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঠেকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান ধর্ণা দেয় গণচীনের দরবারে। পাকিস্তানের প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহম্মদ পিকিং (বেজিং) ছুটে যান এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে চীনা নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার করেন। অতঃপর আজিজ আহমদ এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তানী ১৯৫ যুদ্ধবন্দীর বিচারের সিদ্ধান্ত বাতিল না করা পর্যন্ত পাকিস্তান ও চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য প্রাপ্তির বিরোধিতা করে যাবে।’
১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট যে দিল্লী চুক্তি সই হয়, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে হয়। চুক্তিতে বলা হয়, পাকিস্তান বাঙালী ‘গুপ্তচরদের’ বিচার করবে না। আর যে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের বিচার হবে এবং বাংলাদেশেই হবে। তবে এ ব্যাপারে যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে, তবেই তা হবে। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে তাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা এরপরও উল্লেখ করতে থাকে। কিন্তু, এই চুক্তির ফলে একতরফাভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আর থাকেনি। দিল্লী চুক্তি স্পষ্ট করেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের আর বিচার হচ্ছে না। কারণ, পাকিস্তান এ প্রশ্নে কখনই বাংলাদেশের সঙ্গে সহমত ঘোষণা করতে চায় না। দিল্লী চুক্তিকে পাকিস্তানী সংবাদপত্রে উপমহাদেশে নতুন সম্পর্কের সূচনা করবে বলে অভিমত জানায়। নিউইয়র্ক টাইমসের ২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বলা হয়, নতুন সম্পর্ক হয়ত এখনই শুরু হচ্ছে না। কিন্তু এ কথায় কোনো ভুল নেই যে, এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে।
১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আলজিরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনকালে সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করেন। বাদশাহ ফয়সল দাম্ভিকতার সঙ্গে শর্তারোপ করেন যে, বাংলাদেশকে সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে দেশটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ রাখতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাদশাহকে কড়া জবাব দিয়ে যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে বলেন, ‘এটা তো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয়। এই দু’টো দেশের মধ্যে এ ধরনের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানী নাগরিককে সে দেশে ফেরত নেয়া এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে বাংলাদেশে পাঠানো এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থ সম্পদ পরিশোধ করা। এমন বেশকিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। আর এ সবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু বিনা শর্তে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর সৌদি আরবই বা এত উদগ্রীব কেন?’ বঙ্গবন্ধুর কড়া ভাষ্য শুনে সৌদি বাদশা একটু রূঢ়স্বরে বলেন, ‘শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। যা হোক, আমার শর্ত দুটি বিবেচনা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে, বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা ও অপরটি বিনা শর্তে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। আশা করি, এরপর বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোন কমতি হবে না।’ সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং পশ্চিমা অনেক দেশই যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিপরীতে অবস্থান নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের বিচারের বিষয়ে তখনও অনড় অবস্থানে। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী ছাড়া বাকি যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যাবাসনে আপত্তি তোলেনি। কিন্তু পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের ছাড়া যুদ্ধবন্দীদের ফেরত নিতে আপত্তি বজায় রাখে। ভুট্টো জানতেন, যুদ্ধবন্দীদের ভারত এমনিতে ফেরত দিতে বাধ্য হবে। কারণ বেশিদিন ভরণ-পোষণ দিতে পারবে না। আর পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের নিরাপত্তা বা সুরক্ষার দায়িত্ব তার নেই। যদিও বেশিরভাগ বাঙালিই যুদ্ধের সময় থেকেই চাকরি হারাতে থাকেন। বেকারত্বের কারণে তারা সহায়-সম্পদ সবই বিক্রি করতে বাধ্য হন। এসব তথ্য জেনে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৮ মার্চ জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে এই করুণ অবস্থার অবসানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
১৯৭৩-এর ২৮ আগস্ট দিল্লীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈঠকটি হয় বাংলাদেশের সম্মতিতেই। বৈঠকে উভয় দেশ, ‘দিল্লী চুক্তি’ সই করে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে যুগপৎ প্রত্যাবাসন নিয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। অপরদিকে শর্তারোপ করা হয়, পাকিস্তান গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে আটক বাঙালীদের বিচার করবে না। তবে বাংলাদেশ সেদেশে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর যে বিচার করতে চায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ঐকমত্য হলেই তবে বিচার হবে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তার সরকারের দৃঢ়তার কথা বিভিন্ন পর্যায়ে তখনও বিবৃত করেছেন। কিন্তু এই চুক্তির ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার নামে প্রথম সপ্তাহেই ১৪৬৮ বাঙালি এবং ১ হাজার ৩শ’ ৮ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসন ঘটে। বাংলাদেশ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী ফেরত না দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় পাকিস্তান দুই শতাধিক বাঙালিকে পণবন্দী হিসেবে জিম্মি করে রাখে। এসব সিদ্ধান্তের আগে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ভুট্টো একটি নতুন প্রস্তাবও রেখেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তান তার যে কোন যুদ্ধবন্দীর বিচার ঢাকায় অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে, কারণ অভিযুক্ত অপরাধ পাকিস্তানের একটি অংশেই ঘটেছে। সুতরাং পাকিস্তান নিজে বিচার বিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের বিচারে আগ্রহী। যা আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।’ (পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স, ১ মে ১৯৭৩)। কিন্তু টিক্কা খান পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকাবস্থায় এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচারে পাকিস্তানী প্রস্তাবে সন্দেহ পোষণ করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে যে বিচার করা সম্ভব হবে না তা বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ তখন আটকেপড়া নির্যাতিতসহ সাধারণ বাঙালিদের দেশে ফেরত আনা জরুরি হয়ে পড়েছে অথচ এই বাঙালিদের ভাগ্য জড়িয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে। এক দোটানায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। তথাপি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার আগে পাকিস্তানের কাছে চারটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ খোলা রাখা এবং তৃতীয়ত, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য, চীনসহ অন্যান্য দেশে পাকিস্তানের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রশ্নে শর্তসাপেক্ষে ভুট্টোকে একক ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়। ভুট্টো সংসদে বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের দাবি পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত কোন স্বীকৃতি নয়।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ভাষণে বলেন, ‘১৯৫ যুদ্ধবন্দীর মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের শর্ত অপূর্ণই থেকে যাবে। আর জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রশ্নই ওঠে না।’ এর ১২ দিন পর ৩ অক্টোবর চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী চিয়ান জিয়ান হুয়া অধিবেশনে বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রস্তাব কার্যকরী করার পরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারে। তার আগে কোনক্রমেই নয়।’
দিল্লীতে ১৯৭৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে তিন দেশীয় প্রতিনিধিরা এক যুক্ত ঘোষণায় বলেন, উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলার স্বার্থে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেয়া হবে। অবশ্য এই যুক্ত ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের প্রথম দলটি ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌঁছে। কিন্তু এরপর প্রত্যাবাসন থেমে যায়। পাকিস্তান এ ব্যাপারে টালবাহানা শুরু করে অথচ যুক্ত ঘোষণায় ত্রিমুখী লোক বিনিময় যুগপৎ পরিচালিত হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ২২ অক্টোবর টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে প্রতিটি বাঙালী ফেরত নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী নাগরিকদের বিপুলসংখ্যককেই পাকিস্তান নিচ্ছে না।’ এর ক’দিন পরই ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, ‘পাকিস্তান বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিক বিহারিদের ফেরত নেবে না।’ অথচ প্রায় পাঁচ লাখ বিহারির মধ্যে অধিকাংশই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে দেশে ফেরত যেতে আগ্রহী। বাংলাদেশের পক্ষে এদের ভরণ-পোষণ ভারবাহী হয়ে দাঁড়ায় গোড়াতেই।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনকালে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী ও আটকেপড়া বাঙালীদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু বৈঠক চলাকালে সাংবাদিকদের জানান, ‘পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাঙালীদের দেশে ফেরাসহ অনেক বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন হবে। এই সম্মেলন শুরুর আগে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আল্লাহর নামে এবং দেশের জনগণের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা করছি।… আমি বলছি না যে, এটি আমি পছন্দ করছি। আমি বলছি না আমার হৃদয় আনন্দিত। এটি আমার জন্য একটি আনন্দের দিন নয়, কিন্তু বাস্তবতাকে আমরা বদলাতে পারব না।’ ভুট্টোর ঘোষণার আগের রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সৌদি আরব, মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ ৩৭টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উভয় দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়াই পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থন হয়। তবে বাংলাদেশ তখনও ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে সরে আসার কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। লাহোর সম্মেলন থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু জানালেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি আপাতঃ স্থগিত রেখেছেন। তবে বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান শীঘ্রই আলোচনায় বসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। যেখানে পরস্পর পরস্পরকে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের জন্য অভিযোগ করেছে। ভুট্টো এই কমিশনের প্রতিবেদনে যেমন প্রকাশ করেননি, তেমনি ১৯৫ জনকে বিচারের মুখোমুখি করেননি। কারণ প্রধান আসামি কসাই টিক্কা খান তখন ভুট্টোর সেনাপ্রধান। দিল্লী চুক্তিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও ভুট্টো তা করেনি। অপরদিকে চুক্তিতে আটকেপড়া বাঙালীদের দেশে ফেরত পাঠানোর উল্লেখও রয়েছে। ভুট্টো চুক্তির কোনটিই আসলে কার্যকর করেনি। কারণ ভুট্টো বলেছিল, চুক্তির আগে যে পাকিস্তান নিজে তার জাতীয় আইনের ভিত্তিতে তাদের বিচার করবে। ভুট্টো তো ’৭২ সাল থেকেই নিজে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেনি। সময়টা ছিল বাংলাদেশের প্রতিকূলে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা নাজুক ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ছাড়া আর কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। এমনকি মুসলিম দেশগুলোও নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মতো বাস্তব অবস্থা এবং উপকরণগত সহায়তাও বাংলাদেশের ছিল না।
সে সময় বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়, দুটি কারণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দিতে রাজি হন। প্রথমত, পাকিস্তানে আটকেপড়া প্রায় ৪ লাখ বাঙালী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা তার প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে ‘সম্পদ’ হিসেবে গণ্য হবেন। তাছাড়া, যুদ্ধবন্দী বিচারের ওপর প্রায় ৪ লাখ আটকেপড়া বাঙালী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের জীবন-মরণ ও সুখ-দুঃখ নির্ভর করছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছে এবং সাহায্য দিয়েছে, তাদের মধ্যে ভারত ছাড়া আর প্রায় দেশই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার অনুরোধ জানিয়েছিল।
পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের ভুট্টো জিম্মি করে রেখেছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্ব এ বিষয়ে সেভাবে এগিয়ে আসেনি। ভারত এ ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ বহাল রেখেছিল। কিন্তু এই বাঙালিদের ফেরত আনার জন্যই সেদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল। দিল্লী চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। যদিও তাদের প্রায়োজনই আর জীবিত নেই। কিন্তু মরণোত্তর বিচার কাজটি পাকিস্তানের করা উচিত তাদের নিজেদের স্বার্থে যেমনি, তেমনি বিশ্বের শান্তির স্বার্থেও।
যুদ্ধাপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার নজির বিশ্বে আর নেই। কূটনৈতিক লড়াইটায় খোদ পাকিস্তান বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানীদের একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ও শরণার্থী কমিশন এবং রেডক্রস তাদের নিয়ে কাজ করে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়। রেডক্রস তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টার অংশ হিসেবে নাগরিকত্ব পরিচয় লিপিবদ্ধ করলে, তারা নিজেদের পাকিস্তানী নাগরিক পরিচয় দিয়ে সে দেশে ফেরত যেতে চায়। সে সময় থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিদের ‘আটকেপড়া পাকিস্তানী’ বলে অভিহিত করা হয়।
এদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ৬৬টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে ২৫টি, মোহাম্মদপুরে ৬টি ক্যাম্প। ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস বিদায় নিলে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়। আটকেপড়া পাকিস্তানীদের ফেরত নিতে জেদ্দাভিত্তিক সংগঠন রাবেতা আল আলম ইসলাম জরিপ চালায়। তারা তালিকাও প্রণয়ন করে। সর্বশেষ ২০০৩ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার উর্দুভাষী পাকিস্তানী ৮১টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। এদের ফেরত নিতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক সত্তর দশকে একটি তহবিল গঠন করেছিলেন, কিন্তু তা ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ পুনর্বাসন থমকে থাকায় তা ব্যয় হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ক্যাম্পগুলো বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে চলছে।
১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৯ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের পাকিস্তানী নাগরিক দাবি করে সে দেশে ফিরে যেতে চায়। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই মানবিক সমস্যা মোকাবেলায় একাধিক চুক্তি করে। ইন্দো-পাক এগ্রিমেন্ট ১৯৭৩, জেদ ট্রাইপাটাইট এগ্রিমেন্ট অব বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, ১৯৭৫-এই চুক্তিগুলোর অন্যতম। ১৯৭৪ সালে তিন দেশের মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ মাত্র তিন শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ফেরত নিতে সম্মত হয়। চুক্তির আওতায় পাকিস্তান ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬শ’ ৩৭ জনকে ফেরত নেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে। তবে মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার ৯শ’ ৪১ জনকে ফেরত নেয়। বাকি ৪ লাখ ফেরত নেয়নি।
বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের মূল সমস্যাটি নাগরিকসংক্রান্ত। তারা বাংলাদেশী না পাকিস্তানী? ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দশকগুলোতে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে কাজ করার জন্য অনেক উর্দুভাষী বিহার, উড়িষ্যা ও উত্তর প্রদেশ থেকে পূর্ববঙ্গে আসে। এদের বেশিরভাগই বিহারের। যারা প্রধানত, রেলপুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও অন্য বেসামরিক পদগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন। সৈয়দপুরে বৃহৎ রেল ওয়ার্কশপে কাজ করার জন্য ব্রিটিশরা বিহার থেকে ৭ হাজার জনকে নিয়ে এসেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ ও দাঙ্গার ফলে ১৩ লাখ মুসলিম অধিবাসী পূর্ববাংলায় আসে। এর মধ্যে ১০ লাখ বিহারি। এদের মোহাজির অভিহিত করা হয়। পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতার পাশাপাশি ভাষাগত ভিন্নতার মুখোমুখি হয় তারা। বাংলাভাষা বা লিপি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এ কারণে এবং রাজনৈতিক নীতির কারণেও এরা বাংলা ভাষা এবং বাঙালীকে এড়িয়ে চলে এবং দৃঢ় গোষ্ঠীগত বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। এমনকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হতে বিচ্ছিন্ন থাকে। এরাই হিন্দুদের জমিজমা দখল করার জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগী হয়ে গণহত্যায়ও অংশ নেয়। এরা আলশামস বাহিনী গঠন করেছিল।
১৯৯২ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয় যে, তিন শ’ বিহারি পরিবারকে পাকিস্তানে ফেরত নেয়া হবে। কিন্তু ১৯৯৩ সালে মাত্র ৫০ পরিবারকে ফেরত নেয়ার পর প্রক্রিয়াটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ বিষয়টি উত্থাপন করলেও সন্তোষজনক কোন সুরাহা হয়নি। আটকেপড়া সবাইকে ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধ পাকিস্তান উপেক্ষা করে আসছে। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারের সহযোগী বিহারিদের বাংলাদেশ জিম্মিও করেনি কিংবা যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের বিচারের আওতায় আনেনি। এরা ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর দখলে রেখেছিল। মুখোমুখি সশস্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তা মুক্ত করে।
চিত্রনির্মাতা-সাহিত্যিক জহির রায়হান ওখানেই গুলি বিনিময়ের সময় নিহত হন। পাকিস্তান আটকেপড়া পাকিস্তানীদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য যে কমিটি করেছে, তারা সম্প্রতি সুপ্রীম কোর্টে বলেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৪ থেকে ৫ লাখ পাকিস্তানী আটকে পড়ে আছে। পাকিস্তান এদের ফেরত এবং দায়-দায়িত্ব নেবে না। বাংলাদেশকেই এদের দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য বলে দিয়েছে, ’৭১ পূর্ব সময়ে জন্মগ্রহণকারী পাকিস্তানীদের ফেরত নিতে হবে।
১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গোলাম আযমের বিচার সম্পর্কে বিতর্ক হয়। বিএনপির মন্ত্রী জমিরউদ্দিন সরকার, রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ বিএনপি সরকার পক্ষের কতিপয় সদস্য বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় রাজাকার ও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘যেসব রাজাকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ছিল, তাদের ক্ষমা করা হয়নি। ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা সংসদে আরও বলেন, পাকিস্তানে আটকেপড়া ৪ লাখ বাঙালীকে ফিরিয়ে আনার জন্যই সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল।’ শেখ হাসিনা এমনও বলেন, ‘সেনাপতি নূরউদ্দিন খান, বিডিআরপ্রধান আবদুল লতিফ, জেনারেল সালাম, মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, মাজেদুল হকসহ ৪ লাখ বাঙালী পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় ছিল, তাদের পরিবার-পরিজনদের মাতমে সাড়া দিয়েই বঙ্গবন্ধু সেদিন যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী সেনাদের ছেড়ে দিয়ে আটকেপড়া বাঙালীদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। (সংবাদ ১৬ এপ্রিল ১৯৯১)।
পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিরা শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে পেরেছিল। তেমনি ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীও পাকিস্তান ফিরেছিল বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু বিহারিদের আর বিনিময় হয়নি। দিল্লী চুক্তি রক্ষা করে পাকিস্তান ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে বিচার করেনি যেমন, তেমনি বিহারিদের ফেরত নিচ্ছে না। বিশ্ব জনমতই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে।
লেখক : মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
Posted ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২
ajkerograbani.com | Salah Uddin