রবিবার ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ট্রলারে ১০ মরদেহ: নেপথ্যে কী, তদন্তে পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট

বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে ট্রলারে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ধোঁয়াশা কাটছেই না। এ হত্যাযজ্ঞের মূল কারণ পুলিশের কাছে এখনো অস্পষ্ট। তবে রহস্য উদ্‌ঘাটনে তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মামলার বাদীর দাবি, তার স্বামী প্রকৃত জেলে; এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে নিতে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি মহল।

যে ট্রলারে ১০টি মরদেহ পাওয়া যায়, এর মধ্যে সেটির মালিক মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের হরিয়ারছড়া এলাকার ছনখোলা পাড়ার মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে শামসুল আলম প্রকাশ শামসু মাঝিও রয়েছেন। তার পরিবার এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বাইট্টা কামাল ও করিম সিকদার দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন।

নিহত শামসু মাঝির স্ত্রী ও মামলার বাদী রোকেয়া বেগম বলেন, গত ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় তার স্বামীর নেতৃত্বে ট্রলারযোগে সাগরে যান ১১ জন। ৮ এপ্রিল সকালে স্বামীর সঙ্গে ফোনে সর্বশেষ কথা বলেন। এরপর আর যোগাযোগ করতে পারেননি।

রোকেয়া বেগম দাবি করেন, শামসু মাঝি নিবন্ধিত জেলে; এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে নিতে তাকে ডাকাত বলে প্রচার করছে একটি মহল।

নিহত শামসু মাঝির ভায়রা ভাই মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, বাইট্টা কামালের ট্রলারের এক জেলে সেফায়েত তাকে ফোনে জানিয়েছেন শামসু মাঝির ট্রলার ডাকাতি করেছে তাই কয়েকটি ট্রলারের জেলেরা তাদেরকে মেরে ফেলেছে। সেফায়েত এ ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন বলেও জানিয়েছেন। কিন্তু সেফায়েত যে নম্বর থেকে ফোন করেছে সে নম্বর এখন বন্ধ।

এদিকে শামসু মাঝিকে ডাকাত তকমা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রাও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, একটি মহল তাকে ডাকাত বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

যদিও জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, শামসু মাঝির ট্রলারটি সমিতির আওতাভুক্ত নয় এবং মরদেহগুলো প্রকৃত জেলেদের কিনা সন্দেহ রয়েছে।

এদিকে ঘটনার পর থেকে বাইট্টা কামালসহ যেসব ট্রলারের কথা বলা হচ্ছে সেসব ট্রলার ও জেলেদের হদিস নেই। সরেজমিনে মাতারবাড়ি জেলে ঘাট ও বদরখালী ঘাটে গিয়ে ট্রলার বা জেলেদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

বদরখালী ফিশিং বোট মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আবুল হামেশ সিকদার বলেন, বাইট্টা কামাল, আনোয়ার হোসেন বা বাবুল মাঝির ট্রলারগুলো সমিতির আওতাভুক্ত নয়। আর বাইট্টা কামালের ছোট ভাইয়ের ট্রলার ও মাঝি মাল্লাদের মাঝে মধ্যে দেখা যেত। কিন্তু এখন ট্রলার বা জেলেদের দেখা যাচ্ছে না।

পুলিশ জানিয়েছে, সব বিষয় বিবেচনা করে তদন্ত চালাচ্ছে তাদের ৫টি দল।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার হওয়া দুই আসামিকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জানা যাবে ঘটনার মূল রহস্য। নিহতরা ডাকাত নাকি জেলে, ডাকাতরা তাদের হত্যা করেছে নাকি ক্ষুব্ধ জেলেরা হত্যা করেছে, নাকি হত্যার নেপথ্যে অন্য কিছু রয়েছে, সবকিছুই বিবেচনা নিয়ে তদন্ত চলছে।

ঘটনার ডালপালা বাঁশখালী থেকে গহিরার দিকেও

১০টি মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। এর মধ্যে পুলিশ ৩ জনকে এবং র‌্যাব ২ জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে আদালতের আদেশে ২ আসামি ৫ দিন করে রিমান্ডে রয়েছে। অপর ৩ জনের মধ্যে বুধবার রাতে প্রযুক্তিগত সহায়তায় চকরিয়া উপজেলার বদরখালী এলাকা থেকে গিয়াস উদ্দিন মুনির (৩২) নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মুনির বদরখালী এলাকায় মো. নুর নবীর ছেলে। তাকে এরই মধ্যে আদালতে পাঠিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে; তবে শুনানি হয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনায় সন্দেহজনক ২ জনকে আটক করে পুলিশের কাছে র‌্যাব সোপর্দ করেছে।

এরা হলেন: বাঁশখালীর কুদুকখালী এলাকার মৃত সিরাজুল হকের ছেলে ফজল কাদের মাঝি (৩০) ও শামসুল আলমের ছেলে আবু তৈয়ব মাঝি (৩২)।

একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য মতে, এ ঘটনায় বাঁশখালীর ফজল কাদের মাঝি, আবু তৈয়ুব মাঝি ছাড়াও বাঁশখালীর নেজাম মাঝি ও শাহাব উদ্দিন মাঝি জড়িত থাকতে পারে। ঘটনার সময় শাহাব উদ্দিন মাঝি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তিনি গোপনে কোথাও চিকিৎসা নিচ্ছেন। নেজাম মাঝি ও শাহাব উদ্দিন মাঝিকে গ্রেফতারে জোর তৎপরতাও চলছে। একই এ ঘটনায় শামসু মাঝির ট্রলার থেকে লুট হওয়া মালামাল গহিরা নিয়ে মজুত করা হয়েছে। এর সঙ্গে সেখানকার একটি চক্রও জড়িত। আর মুসা গহিরায় অবস্থান নিয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।

ঘটনাটি সাগরের ডাকাত হত্যা বলে প্রচার করতে মরিয়া চক্রটি কারা

১০টি মরদেহ উদ্ধারের পর সম্ভাব্য ৪টি কারণ সামনে রেখে পুলিশ তদন্তের কথা জানালেও বিষয়টি কী কারণে ঘটেছে তা পরিষ্কার করা হয়নি। এরপর গত ১১ এপ্রিলের পর থেকে শামসু মাঝির নেতৃত্বে ট্রলার ডাকাতি করতে গিয়ে এদের হত্যার কথা নানাভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। যদিও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, সাগরে সুনির্দিষ্ট কোন ট্রলারে ডাকাতির কোন তথ্য পুলিশের কাছে কেউ জানাননি।

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ডাকাতদের হত্যার কথা প্রচার হওয়ায় খুব বেশি বিব্রত হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন শামসু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম। তিনি জানিয়েছেন, বাইট্টা কামাল, তার ভাই ও আত্মীয় স্বজন, করিম সিকদাররা মিলে তার স্বামীসহ সকলকে ডাকাত বলে প্রমাণ করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। এর জন্য টাকা বিনিয়োগেরও অভিযোগ করেন তিনি।

কারা এই টাকা বিনিয়োগ করছেন পরিষ্কার না করলেও রোকেয়া বেগম জানান, একটি প্রভাবশালী চক্র এতে জড়িত। তার স্বামী ডাকাত না। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতেই এমন প্রচারণা।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘটনাটি নিয়ে মন্তব্য করা উচিত না। ডাকাতি না ভিন্ন কিছু এটা দেখছে পুলিশ।

গত ২৩ এপ্রিল সাগরে ভাসমান থাকা ট্রলারটি নাজিরারটেক উপকূলে নিয়ে আসে জেলেরা। আর ওই ট্রলারের হিমঘরে হাত-পা বাঁধা ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরই মধ্যে উদ্ধার হওয়া ৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করলেও মর্গে রয়ে গেছে ৪ জনের মরদেহ ও কঙ্কালটি। ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এ ৫ জনের পরিচয়।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ২:১৭ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]